এদেশের কলেজ সমূহে রসায়ন শাস্ত্রের আদর তখনও হয় নাই। একমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়মিত ভাবে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপনা হইত। লেবরেটরিতে ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ (পরীক্ষা) করা হইত। বেসরকারী কলেজের সংখ্যা খুব কম ছিল। এবং তাহাদের তেমন সঙ্গতি না থাকাতে বিজ্ঞান বিভাগ তাহারা খুলিতে পারে নাই। কিন্তু এই সব কলেজের ছাত্রেরা নামমাত্র “ফি” দিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাসে অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনিতে পারিত। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহা কর্তৃক ১৮৭৬ খৃঃ প্রতিষ্ঠিত Indian Association for the Cultivation of Science বা ভারতীয় বিজ্ঞান সমিতিতেও পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে বক্তৃতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন এবং সাধারণে ইহাতে নামমাত্র ফি দিয়া যোগ দিতে পারিত। আমার স্মরণ হয়, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার গবর্ণমেণ্টের নিকট এই মর্মে পত্র লিখেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানের ক্লাশে বেসরকারী কলেজের ছাত্রদের যোগদানের যে ব্যবস্থা আছে তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হউক নতুবা বিজ্ঞান সমিতির বক্তৃতা-গৃহ শূন্য পড়িয়া থাকিবে। ইহাতে বিজ্ঞান সমিতির উপর কোন দোষারোপ করা হয় নাই, বরং সাধারণ ভারতীয় যুবকদের মনের পরিচয়ই পাওয়া যাইতেছে। পরীক্ষার জন্য যদি কোন পাঠ্য বিষয় নির্দিষ্ট না করা হয়, তবে কোন ছাত্র তাহার জন্য পরিশ্রম করিবে না। গবর্ণমেণ্টেরও শীঘ্রই এইরূপ ব্যবস্থা করিতে হইত, কেন না বিজ্ঞান ক্লাশে ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছিল এবং “বি” কোর্স (বিজ্ঞান) ক্রমেই ছাত্রদের নিকট অধিক প্রিয় হইয়া উঠিতেছিল। গত শতাব্দীর আশীর কোঠায় রসায়ন শাস্ত্রের বিরাট পরিবর্তন হইয়াছিল এবং শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষগণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে কেবলমাত্র কতকগুলি প্রাথমিক বিষয়ে বক্তৃতা দিলেই চলিবে না, পরীক্ষাগারে গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থাও করিতে হইবে। এই সমস্ত কারণ প্রদর্শন করিয়া পেড্লার শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টরকে লিখিলেন তিনি যেন বাংলা গবর্ণমেণ্টকে একজন অতিরিক্ত অধ্যাপক মঞ্জুর করিবার জন্য অনুরোধ করেন। ঠিক এই সময়ে আমি এডিনবার্গ হইতে আসিয়া ঐ অধ্যাপকের পদের জন্য প্রার্থী হইলাম।
উচ্চতর সরকারী পদে ভারতীয়দের নিয়োগের ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, ঐ বিষয়ে সদিচ্ছা ও বড় বড় প্রতিশ্রুতির অভাব নাই। কিন্তু কার্যত বিশেষ কিছুই ঘটে না। ১৮৩৩ ও ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেণ্ট ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে নূতন সনদ প্রদান উপলক্ষে যে আলোচনা হয়, তাহা পাঠ করিলে দেখা যাইবে অনেক উদারভাবপূর্ণ কথা বলা হইয়াছিল। ১৮৩৩ সালে মেকলের বক্তৃতা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা রূপে গণ্য হইয়া থাকে। মেকলে ১৮৩৪ সালে ভারত গবর্ণমেণ্টের আইন সচিব হইয়া আসিলে ইংরাজী শিক্ষিত ভারতবাসীদের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সম্ভবতঃ লণ্ডনে বিখ্যাত সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গেও তাঁহার পরিচয় হইয়াছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত ভারতীয় মেধা কতদূর শক্তিশালী হইতে পারে, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে নূতন সনদ প্রদান উপলক্ষে পার্লামেণ্টে তিনি যে আবেগময়ী বক্তৃতা করেন, তাহাতে নিম্নোদ্ধৃত চিরস্মরণীয় কথাগুলি আছে:—
“আমাদের শাসন নীতিতে ভারতবাসীদের মন এতদূর প্রসারিত হইতে পারে যে শেষে ঐ নীতিকে সে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে। সুশাসনের দ্বারা আমরা এদেশের জনসাধারণকে অধিকতর উন্নত গবর্ণমেণ্ট পরিচালনার উপযোগী করিয়া তুলিতে পারি। ইউরোপীর জ্ঞান বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত হইয়া তাহারা ভবিষ্যতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের জন্যই দাবী করিতে পারে। এমন দিন কখনও আসিবে কি না, আমি জানি না। কিন্তু