করিয়া প্রধানত আমার সময় কাটিত। কলিকাতার নিকটবর্তী অঞ্চল হইতে আমি কয়েক প্রকার উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। অবশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজের জন্য একটি অধ্যাপকের পদ মঞ্জুর হইল এবং আমি ২৫০৲ টাকা বেতনে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হইলাম। স্থানীয় গবর্ণমেণ্টের এর বেশী বেতন মঞ্জুর করিবার ক্ষমতা ছিল না।
আমি স্বীকার করি যে, ছয় বৎসর বিলাতে থাকিয়া এবং সেখানকার স্বাধীন আবহাওয়ার অননুপ্রাণিত হইয়া আমার মধ্যে যথেষ্ট তেজস্বিতা ছিল এবং আমার দেশবাসীর অধিকার সম্বন্ধে একটা উচ্চ ধারণা মনে পোষণ করিয়াছিলাম। আমি সোজা দার্জিলিংএ গেলাম এবং ক্রফ্ট সাহেবকে আমার প্রতি যে অবিচার হইয়াছে, তাহা বলিলাম। আমার মত যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ব্রিটিশ রাসায়নিককে যদি আনিতে হইত তবে ভারত সচিব তাঁহাকে একেবারে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ করিতেন এবং ভারতে আসিবার জন্য জাহাজ ভাড়া পর্যন্ত দিতেন: ক্রফ্ট ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেহ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করিবার জন্য বাধ্য করিতেছে না।” আমি যথাসম্ভব প্রশান্ত ভাবে এই অপমান হজম করিলাম। ক্রফ্টের অনুকূলে এই কথা বলা উচিত হইবে যে তাঁহার ক্রোধ কতকটা বাহ্যিক, আন্তরিক নহে। তিনি বেশ জানিতেন যে তিনি গবর্ণমেণ্টের নির্মম শাসনতন্ত্রের একটা অংশমাত্র এবং তাঁহার পক্ষে আদেশ পালন করাই একমাত্র কর্তব্য, তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার তাঁহার ছিল না। দুই বৎসর পরে ঘটনাক্রমে আমি জানিতে পারি যে, ক্রফ্ট নিজে অন্ততঃ আমাকে ইম্পিরিয়াল বিভাগে লইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমার একজন দূর আত্মীয় সেক্রেটেরিয়েটের জনৈক—“কন্ফিডেন্শিয়াল” কেরাণীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাকে এক টুকরা কাগজ দেন, উহাতে শিক্ষা বিভাগের কর্তার রিপোর্ট হইতে নিম্নলিখিত কয়েক লাইন উদ্ধৃত করা ছিল:—“মল্লিক ও বেলেটের অবসর গ্রহণের পর ইম্পিরিয়াল বিভাগে আরও দুইটি পদ খালি হইবে। তাহার একটা ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে দিতে হইবে। মিঃ পেডলার ইঁহার খুব প্রশংসা করিয়াছেন।” ইহা হইতে দেখা যাইবে, যদিও আমি মাসিক ২৫০৲ টাকা বেতনে “unclassified” তালিকায় নিযুক্ত হইয়াছিলাম, কিন্তু আমাকে যথাসময়ে ভারত সচিবের অনুমোদনক্রমে ইম্পিরিয়াল বিভাগে লইবার উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বিশেষ প্রসন্ন ছিল না। এই সময়ে স্যার চার্লস ইলিয়ট বাংলা দেশের শাসন ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি সভয়ে দেখিলেন যে আরও কয়েকজন বাঙালী কেম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড ও লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইয়াছেন এবং ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। আমাকে যদি ইম্পিরিয়াল বিভাগে লওয়া হয়, তবে আদর্শটা বড় খারাপ হইবে এবং অন্য সকলকে বিমুখ করা কঠিন হইবে। সুতরাং শিক্ষা বিভাগে “অবাঞ্ছনীয়” লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করিয়া বিভ্রাট ঘটাইতে না পারে, তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে হইবে। তিনি একটি ফতোয়া জারী করিলেন যে, ভারত সচিব যত দিন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রস্তাবাবলী অনুমোদন না করেন, ততদিন পর্যন্ত ভারতীয়দিগকে ইম্পিরিয়াল বিভাগে গ্রহণ করা স্থগিত রহিল।
কিন্তু ভারত সচিবের দপ্তরে আমাদের জন্য তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্ত করিবার জন্য মাথা ব্যথা ছিল না। ব্রিটিশ কর্মচারীদের একচেটিয়া সিভিল বা মিলিটারী সার্ভিসের পক্ষে ক্ষতিকর কোন ব্যাপার যদি হইত, তবে ভারত সচিবের জীবন দুর্বহ হইয়া উঠিত, পার্লামেণ্টে তাঁহাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হইত। ডেপুটেশানের পর ডেপুটেশান