পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৫৭

যাইয়া প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করিত। লণ্ডন “টাইমস” আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া উঠিতেন, ভারতসচিবকে ভীতি প্রদর্শন করিতেন। আধুনিক কালের “লী কমিশনের” ব্যাপার অনুধাবন করিলেই কথাটা বুঝা যাইবে। যাহোক, এখন আমি এ বিষয়ের আলোচনা বন্ধ রাখিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার অধ্যাপক জীবনের কথাই বলিব।

 আমি ১৮৮৯ সালে সেসনের প্রথমে কাজে যোগদান করি। আমার পক্ষে সত্যই এ আনন্দের কথা। লেবরেটরীতে গবেষণার কাজই আমার জীবনের প্রধান অবলম্বন এবং ইহার জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। রসায়ন বিভাগ তখন একটা একতলা দালানে ছিল। ১৮৭২ সালে বর্তমানের নূতন বাড়ীতে উঠিয়া যাইবার পূর্বে হেয়ার স্কুল ঐ একতলা বাড়ীতে ছিল। রসায়ন বিভাগের বর্তমান বাড়ীতে যে স্থান, তাহার তুলনায় অতি সামান্য স্থানই পুরাতন একতলা বাড়ীতে ছিল। এই বিজ্ঞান শাস্ত্র কতটা উন্নতি করিয়াছে, উপরোক্ত ঘটনা হইতে তাহাও অনুমান করা যাইতে পারে।[] একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, ১৮৭০ সালে প্রথম যখন আমি হেয়ার স্কুলে প্রবেশ করি, তখন যে স্থানে বেঞ্চের উপর বসিতাম, এখন আমার নিজের বসিবার ঘরে চেয়ারখানা ঠিক সেই স্থানেই পাতা হইয়াছিল।

 যাহারা রসায়নশাস্ত্র প্রথম শিখিতেছে, এমন সব ছাত্রের শিক্ষকতায় সাফল্যলাভ করিতে হইলে, ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ বা পরীক্ষার কাজে নৈপুণ্য চাই। এমনভাবে এক্সপেরিমেণ্ট সাজাইতে হইবে যে তাহা একদিকে যেমন চিত্তাকর্ষক হইবে, অন্যদিকে বিষয়টিও সহজে বুঝা যাইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব বিবেচনা করিয়া অনেক সময় অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। কোন পদপ্রার্থী হয়ত গবেষণায় প্রশংসনীয় কাজ করিয়াছেন। কিন্তু এই সব ব্যক্তি অধ্যাপকের কাজে সকল সময়ে সাফল্যলাভ করিতে পারেন নাই। ইহার অনেক দৃষ্টান্ত আমি দেখিয়াছি। রসায়নের লেকচারারের পক্ষে সহকারীরূপে কিছুদিন শিক্ষানবিশী করা অত্যাবশ্যক। যাঁহারা এটর্নি বা উকীল হইতে চান, তাঁহাদিগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া কোন এটর্নির কার্যে বা প্রবীণ উকীলের নিকটে কিছুকাল শিক্ষানবিশী করিতে হয়। তারপর স্বাধীনভাবে ব্যবসা করিতে পারেন। কোন “থিসিস” বা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখিয়া যাঁহারা বিজ্ঞানে ‘মাষ্টার’ বা “ডক্টর” উপাধি লাভ করেন, তাঁহাদিগকে যদি অকম্মাৎ ছাত্রদের অধ্যাপনা করিতে হয়, তবে তাঁহারা হয়ত মুস্কিলে পড়িবেন। লেবরেটরিতে অতি সাধারণ পরীক্ষা কার্যেও তাঁহাদিগকে ইতস্ততঃ করিতে হয়। একটা সঙ্কোচের ভাব আসে, ফলে তাঁহারা ঐ সব ‘পরীক্ষা’ বাদ দিয়াই যান এবং কেবলমাত্র যন্ত্রটি দেখাইয়া অথবা তদভাবে বোর্ডের উপর চিত্র আঁকিয়াই তাঁহাদের কর্তব্য শেষ করেন। আমার সৌভাগ্যক্রমে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগে পূর্ব হইতেই একটা বনিয়াদ গড়িয়া উঠিয়াছিল। পেডলার বাষ্প (গ্যাস) বিশ্লেষণে বিশারদ ছিলেন এবং পরীক্ষা কার্যে তাঁহার অসীম দক্ষতা ছিল। তাঁহার হাতের নৈপুণ্যও আমাদের সকলের প্রশংসার বিষয় ছিল। দুই একজন সহকারীকে তিনি বেশ শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শিক্ষানবীশরূপে প্রথমে কাজ আরম্ভ করেন। অধ্যাপনায় সাফল্যলাভেই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, সুতরাং সেজন্য মিথ্যা গর্ব আমি ত্যাগ করিলাম। বিলাত ফেরত গ্রাজুয়েটদের


  1. Fifty years of Chemistry at the Presidency College, “Presidency College Magazine” vol. I., 1914, p. 106.