পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
৫৯

দুধ হইতে যে মাখন হয় তাহার স্নেহ উপাদান ব্রিটিশ গরুর দুধের মাখনের চেয়ে একটু স্বতন্ত্র রকমের। সেই কারণে ইংরাজী খাদ্য সম্বন্ধীয় গ্রন্থে ঐ দেশের মাখনের যে বিশ্লেষণাদির পরিচয় থাকে, তাহা আমাদের পক্ষে নির্ভরযোগ্য নহে। কয়েক প্রকারের তেলের নমুনাও বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিলাম। এই কাজ হাতে লইয়া আমাকে প্রভূত পরিশ্রম করিতে হইল। আমি তিন বৎসর পর্যন্ত এই কার্যে ব্যাপৃত ছিলাম এবং আমার গবেষণার ফলাফল “জার্নাল অব দি এসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল” পত্রিকায় (১৮৯৪), “কয়েক প্রকার ভারতীয় খাদ্যদ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা-প্রথম ভাগ, —চর্বি ও তেল” এই নামে প্রকাশিত হইয়াছিল।[]

 সমাজ সেবা কার্যে ও আমার বেশ উৎসাহ ছিল। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হিসাবে আমি উহার সব কাজে আন্তরিকতার সঙ্গে যোগ দিয়াছিলাম। “ব্রাহ্মবন্ধু সভা” ও তাহার “সান্ধ্যসম্মিলনী” গঠন করিবার ভার আমার উপরেই পড়িয়াছিল, ইহার উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যগণকে একত্রিত করা। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইহাকে “commonwealth of church of God” বলা যাইতে পারে। ভগবানের এই মন্দিরে সকলেরই সমান অধিকার। আমি ব্রাহ্মসমাজের কার্য নির্বাহক সমিতির (Executive Committee) একজন সদস্য নির্বাচিত হইলাম এবং কয়েক বৎসর সেই পদে কাজ করিলাম।

 ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে সেসনের প্রথমে আমি পুনর্বার সেই পুরাতন অনিদ্রারোগে আক্রান্ত হইলাম এবং ক্রমাগত তিন মাস ভুগিলাম। শান্তিদায়িনী নিদ্রা আমার চক্ষুকে পরিত্যাগ করিল এবং রাত্রির পর রাত্রি জাগ্রত অবস্থায় শয্যায় এপাশ ওপাশ করিয়া আমি অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিতে লাগিলাম। দূরে গির্জার ঘণ্টা বাজিত—আমি গণিতাম। কার্লাইল এবং হার্বাট স্পেন্‌সারের মত দার্শনিকরাও অনিদ্রারোগে ভুগিয়াছেন, একথা মনে করিয়া আমি সান্ত্বনা পাইলাম না; এবং তাহাতে আমার যন্ত্রণাও কমিল না। কলিকাতার রাস্তার ফুটপাতে যে দিন-মজুর গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া রাত্রি কাটায় তাহার সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করিতে লাগিলাম। এক রাত্রি নিদ্রার পর প্রভাতে জাগরণ—আমার নিকট সে কি দুর্লভ বিলাস বলিয়া মনে হইত! অমর কবি সেক্সপীয়রের সেই চিরস্মরণীয় পংক্তিগুলির মর্ম আমি উপলব্ধি করিতে পারিলাম—

“How many thousands of my poorest subjects
Are at this hour asleep! O sleep, O gentle sleep

* * * *

Uneasy lies the head that wears a Crown.”

 আমার ব্যাধি অবশ্য রাজমুকুটের জন্য নহে, অজীর্ণের দরুণ! অক্টোবর মাসে পূজার ছুটীর সময় আমি দেওঘরে হাওয়া বদলাইতে গেলাম। কলিকাতার অপেক্ষাকৃত নিকটে ঐ স্থান স্বাস্থ্যকর বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। ১৮৯১ সালে বেশি লোক ছুটী কাটাইবার জন্য সেখানে যাইত না। বাসগৃহের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। যে ২। ৪ খানি ছিল, তাহাও খুব দূরে দূরে অবস্থিত ছিল। খোলা জায়গা যথেষ্ট ছিল। আমার জনৈক বন্ধু আমার


  1. এখন খাদিপ্রতিষ্ঠানে এই সকল খাঁটি দ্রব্য সরবরাহ করিবার ভার লওয়া হইয়াছে।