পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬০
আত্মচরিত

জন্য একখানি খড়ো বাড়ী ঠিক করিলেন; উহার জরাজীর্ণ অবস্থা। পূর্বে একজন বাগিচাওয়ালা ঐ বাড়ীতে থাকিতেন। কিন্তু আমি ঐ বাড়ী পাইয়া খুব খুসী হইলাম। কেননা উহার চারিদিকে উন্মুক্ত প্রান্তর ও শস্যক্ষেত্র। রাজনারায়ণ বসু তখন দেওঘর বাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। সহস্র সহস্র যাত্রী এই পথে বৈদ্যনাথের মন্দিরে মহাদেবকে দর্শন করিতে যাইত। শিক্ষিত বাঙালীদের নিকট দেওঘরও এক প্রকার তীর্থক্ষেত্র ছিল। তাঁহারা সাধু রাজনারায়ণ বসুকে দর্শন ও তাঁহার সঙ্গ লাভ করিতে আসিতেন। রাজনারায়ণ পারিবারিক জীবনে শোক পাইয়াছিলেন। বয়সেও তিনি অতি বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার কথাবার্তা সরস ও বিবিধ জ্ঞানের ভাণ্ডার স্বরূপ ছিল।

 আমাদের বন্ধু হেরম্বচন্দ্র মৈত্র দেওঘরে আসিয়া শীঘ্রই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। দেওঘর স্কুলের হেড মাষ্টার যোগেন্দ্রনাথ বসু আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তখন মধুসূদন দত্তের জীবনচরিতের উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন। এই অ-পূর্ব জীবনচরিত পরে তাঁহাকে বাংলা সাহিত্যে প্রসিদ্ধ করিয়াছে। রাজনারায়ণ ও মধসূদনের মধ্যে যে সব পত্র ব্যবহার হইয়াছিল, জীবনচরিতের তাহা একটা প্রধান অংশ। রাজনারায়ণ বাবু এগগুলি চরিতকার যোগেন্দ্রবাবুকে দিয়াছিলেন। ঐ সময়ে শিশিরকুমার ঘোষও তাঁহার বাংলোতে বাস করিতেছিলেন। তিনি ‘অমৃতবাজার পত্রিকার’ সম্পাদকীয় দায়িত্ব হইতে সে সময় বস্তুত অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। সতরাং আমি সৎসঙ্গ লাভ করিলাম। আমরা সকলে মিলিয়া নিকটবর্তী পাহাড়গুলিতে বেড়াইতে যাইতাম। যোগেন্দ্রনাথ বসু তাঁহার মধুসূদন দত্তের জীবনচরিতের পাণ্ডুলিপি হইতে অনেক সময় আমাকে পড়িয়া শুনাইতেন। এখানে একটা করুণ রস মিশ্রিত কৌতুককর ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। দেওঘরের সর্বত্র “ভেলার” গাছ। একদিন আমি ঐ গাছের একটী ফল চিবাইয়া খাইলাম। উদ্ভিদ তত্ত্ব অনুসারে ভেলা আমের জাতীয়, সতরাং আমি উহাকে অনিষ্টকর মনে করি নাই। তখনই আমার কিছু হইল না। কিন্তু পরদিন আমার মুখ খুব ফলিয়া গেল, এমন কি চোখ পর্যন্ত ঢাকা পড়িল। বন্ধুরা বিষম শঙ্কিত হইলেন। স্থানীয় চিকিৎসক আমাকে বেলেডোনা ঔষধের প্রলেপ দিলেন। তাহাতেই আমি ভাল হইলাম। এক পর্যায়ের উদ্ভিদের মধ্যে অনেক সময় নির্দোষ ও অনিষ্টকর দুই রকমই থাকে, সে কথা আমার স্মরণ থাকা উচিত ছিল। যথা, আলু, বেগুন, লঙ্কা, বেলেডোনা প্রভৃতি একই উদ্ভিদ পর্যায়ের অন্তর্গত।

 পূজার ছুটীর পর আমি সহরে ফিরিলাম। ইহার এক বৎসর পূর্বে আমি ৯১ নং অপার সার্কুলার রোডের বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম। পরবর্তী ২৫ বৎসর উহাই আমার বাসস্থান ছিল। এইখানেই বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে কাজ আরম্ভ করিবার কিছু দিন পর হইতেই বিজ্ঞান বিভাগে বাংলা সাহিত্যের দারিদ্র্য দেখিয়া আমার মন বিচলিত হয় এবং রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা সম্বন্ধে প্রাথমিক পুস্তিকা লিখিবার আমি সঙ্কল্প করি। স্বভাবত প্রথমেই রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধে পুস্তক লিখিতে আমি প্রবৃত্ত হইলাম। কিন্তু কিছুদূর পর্যন্ত বইখানি লিখিয়া আমি উহা হইতে বিরত হইলাম। আমার মনে হইল প্রাকৃতিক বিষয় অধ্যয়নই বালক বালিকাদের চিত্ত বেশী আকর্ষণ করিবে এবং প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ এই আলোচনার বিপুলক্ষেত্র। জীবজন্তুর গল্প, তাহাদের জীবনযাপন প্রণালী, ভাব, বিশেষত্ব, এই সমস্ত বালক বালিকাদের মন মুগ্ধ করে। ইংরাজীতে এক একটা জীব-গোষ্ঠী সম্বন্ধেই অনেক গ্রন্থ আছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বানর পরিবারের অন্তর্গত গরিলা, শিম্পাঞ্জি ওরাং আউটাং প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ঐ সমস্ত গ্রন্থই প্রত্যক্ষ জ্ঞানলব্ধ তথ্য লইয়া