পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪
আত্মচরিত

নিন্দনীয় বিবেচিত হইতে পারে, কিন্তু তবু ইহা ক্ষমার যোগ্য। এই সমস্ত ফার্ম বিপুল অর্থ ব্যয় ও বহু বৎসর ধরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া তবে হয়ত এমন কোন প্রণালী আবিষ্কার করে, যাহার বলে তাহারা প্রতিযোগিতায় সাফল্যলাভ করিতে পারে। সতেরাং আমি ঐ সকল যাহা দেখিয়াছিলাম তাহা কোন কাজে লাগিল না। ইংল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডে রাসায়নিক কারখানাগুলি খুব বড় আকারে চালানো হয়। উহার আনুষঙ্গিক অন্যান্য শিল্প থাকে এবং তাহাদের পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ বর্তমান। আমি পাঠ্যগ্রন্থে পড়িয়াছিলাম যে সালফিউরিক অ্যাসিড, অন্যান্য সমস্ত শিল্পের মূল স্বরূপ। সেণ্ট রোলক্স (গ্লাসগোতে) টেনাণ্ট এণ্ড কোম্পানির বিরাট সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানা দেখিয়া আমি ঐ কথা বেশ বুঝিতে পারিলাম।

 আমি যখন এই কাজে প্রথম প্রবৃত্ত হই, তখন আমার পশ্চাতে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার পথপ্রদর্শকও কেহ ছিল না। তাহার পর শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ অতীত হইয়াছে। আমদানি রপ্তানির কাজ আশ্চর্যরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে—কিন্তু এই সময়ের মধ্যে রাসায়নিক শিল্পে বাংলায় খুব কম উন্নতিই হইয়াছে! আমি ‘সাল্‌ফেট অব আয়রন’ (হীরাকস) লইয়া কাজ আরম্ভ করিলাম। কলিকাতার বাজারে ইহার চাহিদা ছিল। কুচা লৌহ (Scrap Iron) প্রচুর পরিমাণে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যাইত এবং আমি সালফিউরিক অ্যাসিড সম্বন্ধে সন্ধান করিলাম। কলিকাতায় কলেজে পড়িবার সময় পরীক্ষা কার্যের জন্য আমি স্থানীয় জনৈক ঔষধ-ব্যবসায়ীর নিকট সালফিউরিক অ্যাসিড সংগ্রহ করিতাম। আমি তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছিলাম যে, বিদেশ হইতে সালফিউরিক অ্যাসিড আমদানী করিতে হয় না, কেন না কাশীপুরের ডি ওয়াল্‌ডি এণ্ড কোং প্রচুর পরিমাণে সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এখন অনুসন্ধান করিয়া আমি জানিতে পারিলাম যে, ডি ওয়াল্‌ডির কারখানা ব্যতীত কলিকাতার আশে পাশে আরও ৩।৪টী কারখানায় সালফিউরিক অ্যাসিড তৈয়ারী হয়। এই সব কারখানার মালিক কার্তিকচন্দ্র সিংহ, মাধবচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি। ইউরোপ ও আমেরিকায় সালফিউরিক অ্যাসিড কি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, ইহা যাঁহারা জানেন, কলিকাতার এই সব কারখানার প্রস্তুত সালফিউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ শুনিয়া তাঁহাদের মনে অবজ্ঞার ভাবই আসিবে। এখানে গড়ে এক একটা কারখানায় দৈনিক ১৩ হন্দরের (cwts) বেশী সালফিউরিক অ্যাসিড তৈয়ারী হইত না। সালফিউরিক অ্যাসিড হইতে আর দুইটী ধাতব অ্যাসিড—নাইট্রিক ও হাইড্রোক্লোরিক তৈয়ারী হইত। এগুলি মাটীর কলসীতে চোঁয়ানো হইত। এই প্রাথমিক ধরণে অ্যাসিড তৈয়ারীর ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে বিরক্তি হইল। এই সব ধাতব অ্যাসিড ‘বিপজ্জনক পদার্থ’ বলিয়া জাহাজে আমদানি করিতে খুব বেশী খরচা পড়িত, সেই কারণেই এ দেশে প্রস্তুত অ্যাসিড বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ হইত। আমার যে কিছু সালফিউরিক অ্যাসিড দরকার হইত, ডি ওয়াল্‌ডির নিকট হইতেই তাহা আনাইতাম। কিন্তু এই সময় একটা অচিন্তিতপূর্ব ঘটনায় আমার কার্যের পরিধি বিস্তৃত হইল।

 আমার গ্রামবাসী যাদবচন্দ্র মিত্র আলিপুর ফৌজদারী আদালতে মোক্তারী করিতেন। তিনি এই শ্রেণীর একটি সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানা কিনিয়াছিলেন। আসগর মণ্ডল নামক একব্যক্তি কারখানাটির প্রতিষ্ঠাতা। টালিগঞ্জের প্রায় তিনমাইল দক্ষিণে সোদপুর নামক গ্রামে বাঁশবনের মধ্যে এই কারখানা অবস্থিত ছিল। মিত্র আমাকে কারখানা দেখিবার জন্য অনুরোধ করিলেন এবং বলিলেন যে আমার রাসায়নিক জ্ঞানের দ্বারা আমি ইচ্ছা করিলে কারখানাটির উন্নতি সাধন করিতে পারি। আমার সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ডেমনাষ্ট্রেটার চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীকে লইলাম। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ীর রাসায়নিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার একটা