সহজ প্রতিভা ও দূরদৃষ্টি ছিল। চন্দ্রভূষণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুলভূষণ ভাদুড়ীও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কুলভূষণ রসায়ন শাস্ত্রে এম, এ, এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে স্বর্ণপদক পাইয়াছিলেন।
৩৭ বৎসর পরে আমি এই বিবরণ লিখিতেছি। কিন্তু এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়িতেছে একদিন শনিবার অপরাহ্ণে ছুটীর পর কলেজ হইতেই আমরা কারখানা দেখিতে রওনা হইলাম। ১০×১০×৭ ফিট এই মাপের দুইটি সিসার কামরা লইয়া কারখানা। বলা বাহুল্য এরূপ কারখানাতে ‘গ্লোভার’ বা ‘গে লুসাকের’ টাওয়ার বসাইবার কোন উপায় ছিল না। যে অশিক্ষিত মিস্ত্রী কারখানা তৈরী করিয়াছিল, তাহার এসব জ্ঞানও ছিল না। আমরা খুব ভাল করিয়া কারখানাটি পরীক্ষা করিলাম এবং কি উপায়ে উহার উন্নতি করা যায়, তাহা চিন্তা করিতে লাগিলাম। এইটি এবং অন্যান্য কয়েকটি ছোট ছোট অ্যাসিডের কারখানায় যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহা আমার মনে দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হইল। মনে মনে ক্ষোভ ও গ্লানি অনুভব করিলাম, এমন কথাও বলিতে পারা যায়। ইউরোপের যন্ত্রশিল্প এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, এক একজন লোক কি বিপুল বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়া কাজ করিয়াছে এবং শেষে আপনার অক্লান্ত সাধনার ফল জগৎকে দান করিয়া শিল্প জগতে হয়ত যুগান্তর আনয়ন করিয়াছে, অথচ তাহাদের প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষার সংযোগ হইতে বঞ্চিত। লে ব্ল্যাঙ্ক বিদেশে হাসপাতালে দারিদ্র্যের মধ্যে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, কিন্তু আধুনিক ‘অ্যালকালির’ (alkali) তিনিই আবিষ্কর্তা, জেমস ওয়াট, স্টিফেনসন, আর্করাইট, হারগ্রিভ্স, বার্নার্ড পালিসি প্রভৃতি সকলেরই দরিদ্রের ঘরে জন্ম। কিন্তু তবু তাঁহারা পর্বতপ্রমাণ বাধাকে জয় করিয়া অবশেষে সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন। স্মাইল্সের “ইঞ্জিনিয়ারদের জীবন চরিত” গ্রন্থে দেখি, ঐ সব ইঞ্জিনিয়ারদের প্রায় কেহই ধনীর ঘরে জম্মেন নাই। সাধারণ গৃহস্থের সন্তান তাঁহারা। রাস্তানির্মাতা জন মেটকাফ গরীব মজুরের ছেলে, ছয় বৎসর বয়সে তিনি অন্ধ হন। মিনাই সেতুর নির্মাতা টেলফোর্ড এক বৎসর বয়সে অনাথ হন এবং তাঁহার বিধবা মাতাকে সংসারের সঙ্গে বিষম সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল।
আমি ইহার পর সাজিমাটি লইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলাম এবং ইহা হইতে কার্বনেট অব সোডা প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিলাম। উত্তর ভারতে সাজিমাটি স্মরণাতীত কাল হইতে বস্ত্র প্রভৃতি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। কিন্তু আমি দেখিলাম যে ইহাতে খরচ পোষায় না, কেননা তাহা অপেক্ষা ভাল সাজিমাটি সস্তায় বিক্রয় হয়। ব্রানার মণ্ড এণ্ড কোম্পানির কারখানায় এই সোডা তৈয়ারী হইত। ঔষধ-ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, এই ফার্ম কার্যত এসিয়ার বাজার একচেটিয়া করিয়া ফেলিয়াছে। চীন ও জাপানেও ইহাদের সোডাই চালান যাইত।
ফস্ফেট অব সোডা এবং সুপার ফস্ফেট অব লাইম লইয়া পরীক্ষা করিলাম। এই সব দ্রব্য বিদেশ হইতে কেন আমদানি করিতে হয়! অথচ যে উপকরণ (গবাদি পশুর হাড়) হইতে এই সব দ্রব্য তৈয়ারী হয়, তাহাতো প্রচুর পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি করা হইতেছে। আমার তখনকার কাজের জন্য মাত্র ১০। ১৫ মণ হাড়ের গুঁড়ার প্রয়োজন। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে আমারই বাসস্থানের নিকটে রাজাবাজারে যে সব কসাইয়ের দোকান আছে, ঠিকাদারেরা সেখান হইতে গাড়ী বোঝাই করিয়া হাড় লইয়া যায়। রাজাবাজারে বহু অশিক্ষিত পশ্চিমা মসলমান থাকিত এবং গোমাংস ইহাদের প্রধান খাদ্য ছিল। কয়েক বস্তা কাঁচা হাড় সংগ্রহ করিয়া আমার বাড়ীর ছাদে শুকাইতে দেওয়া হইল। তখন শীতকাল, বাংলাদেশে সাধারণতঃ এই সময়ে আকাশ পরিষ্কার থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বৎসর