পাতা:আত্মশক্তি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৬
আত্মশক্তি।

করিব। আজ আমরা কোনো ক্লেশকে ডরিব না, উপহাসকে অগ্রাহ্য করিব, আজ আমরা পীড়িত জননীর রোগশয্যায় বিলাতের সাজ পরিয়া সৌখীনতা করিতে যাইব না।

 দেশের জিনিষকে রক্ষা করা— এও ত রমণীর একটা বিশেষ কাজ। আমরা ভালবাসিতে জানি! ভালবাসা চাক্‌চিক্যে ভুলিয়া নূতনের কুহকে চারিদিকে ধাবমান হয় না। আমাদের যাহা আপন, সে সুশ্রী হউক্ আর কুশ্রী হউক্, নারীর কাছে অনাদর পায় না,—সংসার তাই রক্ষা পাইতেছে।

 একবার ভাবিয়া দেখুন, আজ যে বঙ্গসাহিত্য বলিষ্ঠভাবে অসঙ্কোচে মাথা তুলিতে পারিয়াছে, একদিন শিক্ষিতপুরুষসমাজে ইহার অবজ্ঞার সীমা ছিল না। তখন পুরুষেরা বাংলা বই কিনিয়া লজ্জার সহিত কৈফিয়ৎ দিতেন যে, আমরা পড়িব না, বাড়ীর ভিতরে মেয়েরা পড়িবে। আচ্ছা আচ্ছা, তাঁহাদের সে লজ্জার ভার আমরাই বহন করিয়াছি, কিন্তু ত্যাগ করি নাই। আজ ত সে লজ্জার দিন ঘুচিয়াছে! যে বাড়ীর ভিতরে মেয়েদের কোলে বাংলাদেশের শিশুসন্তানেরা তাহারা কালোই হউক্ আর ধলোই হউক্—পরম আদরে মানুষ হইয়া উঠিতেছে—বঙ্গসাহিত্যও সেই বাড়ীর ভিতরে মেয়েদের কোলেই তাহার উপেক্ষিত শিশু-অবস্থা যাপন করিয়াছে, অন্নবস্ত্রের দুঃখ পায় নাই।

 একবার ভাবিয়া দেখুন, যেখানে বাঙালিপুরুষ বিলাতী কাপড় পরিয়া সর্ব্বত্র নিঃসঙ্কোচে আপনাকে প্রচার করিতেছেন, সেখানে তাঁহার স্ত্রীকন্যাগণ বিদেশীবেশ ধারণ করিতে পারেন নাই। স্ত্রীলোক যে উৎকট বিজাতীয়বেশে আপনাকে সজ্জিত করিয়া বাহির হইবে, ইহা আমাদের স্ত্রীপ্রকৃতির সঙ্গে এতই একান্ত অসঙ্গত যে, বিলাতের মোহে আপাদমস্তক বিকাইয়াছেন যে পুরুষ, তিনিও আপন স্ত্রীকন্যাকে এই ঘোরতর লজ্জা হইতে রক্ষা করিয়াছেন।