পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ খণ্ড—ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১২৫

 মহেন্দ্র বলিলেন, “মরিলে যদি রণজয় হইত, তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম্ম নহে।”

 জীব। “আমি বৃথাই মরিব। তবু যুদ্ধে মরিব।” তখন পাছু ফিরিয়া উচ্চৈঃস্বরে জীবানন্দ ডাকিলেন, “কে হরিনাম করিতে করিতে মরিতে চাও, আমার সঙ্গে আইস।”

 অনেকে অগ্রসর হইল। জীবানন্দ বলিলেন, “অমন নহে। হরিসাক্ষাৎ শপথ কর, জীবন্তে ফিরিবে না।”

 যাহারা আগু হইয়াছিল, তাহারা পিছাইল। জীবানন্দ বলিলেন,

 “কেহ আসিবে না? তবে আমি একা চলিলাম।”

 জীবানন্দ অশ্বপৃষ্ঠে উঁচু হইয়া বহুদূর পশ্চাৎস্থিত মহেন্দ্রকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভাই! নবীনানন্দকে বলিও, আমি চলিলাম। লোকান্তরে সাক্ষাৎ হইবে।”

 এই বলিয়া সেই বীরপুরুষ লৌহবৃষ্টিমধ্যে বেগে অশ্বচালন করিলেন। বাম হস্তে বল্লম, দক্ষিণে বন্দুক, মুখে “হরে মুরারে! হরে মুরারে! হরে মুরারে!” যুদ্ধের সম্ভাবনা নাই, এ সাহসে কোন ফল নাই—তথাপি “হরে মুরারে! হরে মুরারে!” গায়িতে গায়িতে জীবানন্দ শত্রুব্যূহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

 পলায়নপর সন্তানদিগকে মহেন্দ্র ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, একবার তোমরা ফিরিয়া জীবানন্দ গোঁসাইকে দেখ। দেখিলে মরিবে না।”

 ফিরিয়া কতকগুলি সন্তান জীবানন্দের অমানুষী কীর্ত্তি দেখিল। প্রথমে বিস্মিত হইল, তার পর বলিল, “জীবানন্দ মরিতে জানে, আমরা জানি না? চল, জীবানন্দের সঙ্গে আমরাও বৈকুণ্ঠে যাই।”

 এই কথা শুনিয়া, কতকগুলি সন্তান ফিরিল। তাহাদের দেখাদেখি আর কতকগুলি ফিরিল, তাহাদের দেখাদেখি আরও কতকগুলি ফিরিল। বড় একটা গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। জীবানন্দ শত্রুব্যূহ প্রবেশ করিয়াছিলেন; সন্তানেরা আর কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।

 এদিকে সমস্ত রণক্ষেত্র হইতে সন্তানগণ দেখিতে পাইল যে, কতক সন্তানেরা আবার ফিরিতেছে। সকলেই মনে করিল, সন্তানের জয় হইয়াছে; সন্তান শত্রুকে তাড়াইয়া যাইতেছে। তখন সমস্ত সন্তানসৈন্য “মার মার” শব্দে ফিরিয়া ইংরেজসৈন্যের উপর ধাবিত হইল।