‘আনন্দমঠে’র বিভিন্ন সংস্করণের পাঠভেদ
‘আনন্দমঠ’ বঙ্কিমচন্দ্রের পরিণত বয়সের রচনা হইলেও প্রথম ও পরবর্ত্তী সংস্করণগুলিতে পরিবর্ত্তনের পরিমাণ সামান্য নয়। ঘটনা-সংস্থান ও ‘শান্তি’-চরিত্রের পরিবর্ত্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মত-পরিবর্ত্তনে বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিধা ছিল না; এ বিষয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপনে তাঁহার উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিতেছেন—
মত পরিবর্ত্তন স্বীকার করিতে আমি লজ্জা করি না। আমার জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মতপরিবর্ত্তন করিয়াছি—কে না করে?—মতপরিবর্ত্তন, বয়োবৃদ্ধি, অনুসন্ধানের বিস্তার, এবং ভাবনার ফল। যাহার কখনও মত পরিবর্ত্তিত হয় না, তিনি হয় অভ্রান্ত দৈবজ্ঞানবিশিষ্ট, নয় বুদ্ধিহীন এবং জ্ঞানহীন।
‘আনন্দমঠ’ ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের ‘বঙ্গদর্শনে’ শুরু হইয়া ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে সমাপ্ত হয়। বঙ্কিমের জীবিতকালে ইহার পাঁচটি সংস্করণ হইয়াছিল। ১ম—১২৮৯ বঙ্গাব্দ (১৮৮২), ২য়—১২৯০ বঙ্গাব্দ (১৮৮৩), ৩য়—১২৯২ বঙ্গাব্দ (১৮৮৬, এপ্রিল), ৪র্থ—ডিসেম্বর ১৮৮৬ খ্রীঃ এবং ৫ম—১৮৯২ খ্রীঃ। আমরা ১ম, ২য়, ৩য় ও ৫ম সংস্করণের পাঠ মিলাইয়া দেখিয়াছি। মূল পরিবর্ত্তন সম্বন্ধে তৃতীয় বারের বিজ্ঞাপন ও পঞ্চম বারের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং সংক্ষেপ বিবৃতি দিয়াছেন। প্রথম চারি সংস্করণে ‘আনন্দমঠে’র ঘটনাস্থল ছিল বীরভূম, অজয়ের তীরবর্ত্তী কোনও আরণ্য ও পার্ব্বত্য প্রদেশ; কিন্তু আসলে সন্ন্যাসী-বিদ্রোহ ঘটিয়াছিল উত্তর বঙ্গে। বঙ্কিমচন্দ্র তৃতীয় সংস্করণে এই ভুলের উল্লেখমাত্র করিয়াছেন, পরিবর্ত্তন করেন নাই। পঞ্চম সংস্করণে এই পরিবর্ত্তন করিবার চেষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র করিয়াছেন, কিন্তু সমগ্র গ্রন্থে বীরভূমের নদী, অরণ্য ও পর্ব্বত এমন ভাবে মিশিয়া ছিল যে, সামান্য কয়েকটা নাম তুলিয়া অথবা বদলাইয়া বীরভূমকে বরেন্দ্রভূম করা সম্ভব হয় নাই; বরেন্দ্রভূমিকে ছাপাইয়া বীরভূমিই ফুটিয়া উঠে। পঞ্চম সংস্করণে ‘শান্তিকে অপেক্ষাকৃত শান্ত করা’ হইয়াছে।
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং পঞ্চম সংস্করণের প্রথম খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদে পাঠভেদ অতি সামান্য। কয়েক স্থলে মাত্র কয়েকটি শব্দ যোগ করা হইয়াছে, কিংবা কোন শব্দের বদলে অন্য শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে; আমরা সেগুলির উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন মনে করি। যে সকল স্থলে কোন বিশেষ পরিবর্ত্তন বা পাঠভেদ হইয়াছে, তাহাই উল্লেখ করা গেল।