পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৷৵৹

তাহার এক কারণ বঙ্কিমচন্দ্র সেই সেই যুগের ফোটোগ্রাফ দিতে আদৌ চান নাই; তিনি এগুলিকে গদ্য-কার্য্য আকারে সৃষ্টি করিবেন, লোকশিক্ষার যন্ত্র করিবেন বলিয়া কলম ধরিয়াছিলেন। কিছু কিছু বাস্তব সত্য ইতিহাস হইতে লইয়া, তাহাতে তাঁহার অদ্বিতীয় চরিত্রসৃষ্টির কল্পনা যোগ করিয়া, সবটার মধ্যে নিজ ঊর্দ্ধপ্রবাহিণী ভাবধারা[] ঢালিায়া দিয়া এই গ্রন্থগুলির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিলেন, এক অপূর্ব্ব সামগ্রী বাঙ্গলা সাহিত্যকে দান করিলেন।

 দ্বিতীয় কারণ এই যে, আমাদের দেশ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক মসলার অভাবে উপন্যাস লেখক—অনেক স্থলে পেশাদার ঐতিহাসিকও—কল্পনার সাহায্যে ফাঁক পুরাইতে বাধ্য হন। এ কথাটা অতি পরিষ্কার বুঝা যাইবে, যদি আমরা তাঁহার ‘আনন্দমঠে’র সহিত স্কটের ‘ওল্‌ড্‌ মর্টালিটি’র তুলনা করি। দুইটি গ্রন্থই বিদ্রোহী সন্ন্যাসী বা ধর্ম্মোন্মাদ যোদ্ধাদের রাজশক্তির সহিত সংঘর্ষের কাহিনী। কিন্তু স্কটের গ্রন্থে কভেনাণ্টারদের বাক্য ও কার্য্যগুলির প্রায় সমস্তই ইতিহাসে পাওয়া যায়, কারণ তাহাদের কথাবার্ত্তার রিপোর্ট এবং তাহাদের লিখিত পুস্তিকা ও অসংখ্য চিঠি বর্ত্তমান আছে; ইতিহাস-লেখক বিদ্রোহীদের ঘরের কথা তাহাদের মুখ হইতেই শুনিতে পাইতেছেন; তাহার উপর প্রতিপক্ষের অর্থাৎ গবর্ণমেণ্টের কাগজপত্র কাহিনী তো আছেই। কিন্তু বিদ্রোহী সন্তানগণ নিরক্ষর; তাহারা বা তাহাদের দলের ভিতরে প্রবেশ করিয়া অন্য কেহ সে সময়ে কোন বিবরণ লিখিয়া যায় নাই; তাই আজ আমাদের একমাত্র পুঁজি হেষ্টিংস লাটের কয়খানা চিঠি এবং রেকর্ড অফিসে রক্ষিত নিম্ন ইংরেজ কর্ম্মচারীর কয়খানা রিপোর্ট, সুতরাং এখানে একতরফা অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যানের উপর নির্ভর করিয়া ঐ যুগের ঘটনার বিবরণ ও মানবচরিত সৃষ্টি করা ভিন্ন আমাদের আর উপায় নাই।

 কিন্তু এটা সত্যসত্যই ক্ষতির কারণ নহে। বঙ্কিমের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিতে এমন পদার্থ আছে যাহা “পাথুরে, বিজ্ঞানসম্মত” ইতিহাসে কখন পাওয়া যায় না। সেটি সেই যুগের প্রাণ। ইহার একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। লীটন যখন তাঁহার “লাষ্ট্‌ ডেজ্‌ অব পম্পি” লেখেন, তাহার পূর্ব্বে অনেক দিন ধরিয়া পম্পি-নগরী ধ্বংস হইবার সময় যে সব গ্রীক ও রোমান লোক তথায় বাস করিত তাহাদের ঘরকন্না, হাটবাজার


  1. আইডিয়ালিজম্ কথাটাকে যদি ‘আদর্শবাদ’ বলি, তবে এ অনুবাদে ইংরাজীর গন্ধ থাকিয়া যাইবে তাই উপরের কথাটি ব্যবহার করিব। তেমনি “শিক্ষার বাহন” (vehicle) এই অদ্ভুত শব্দটা শুনা মা শ্রীশ্রীশীতলা দেবীর বাহনকেই প্রথমে মনে পড়ে।