৷৷৹
এবং তাহাদের কার্য্য ও কথা (ইংরেজ সৈন্যের সহিত দুইটা খণ্ডযুদ্ধ বাদে) অনেকাংশে অসত্য এবং এ বইখানি কোন মতেই ঐতিহাসিক এই বিশেষণ পাইতে পারে না।
সে কথা মানিলাম। কিন্তু ‘আনন্দমঠ,’ ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারামে’র মধ্যে যে অমৃতরস আছে তাহা এ তিনখানি গ্রন্থ অপেক্ষা শতগুণ বেশী “সত্য” ঐতিহাসিক কোন উপন্যাসে পাওয়া যায় না। সেই রস বঙ্কিমচন্দ্রের হৃদয়ের ঊর্দ্ধপ্রবাহিণী ভাবধারা-রূপ উৎস হইতে অবিরাম ঝরিতেছে। এই গ্রন্থগুলিতে তিনি দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইয়াছেন যে, আত্মসংযম ও ধর্ম্ম-অনুশীলনের ফলে মানব-চিত্ত ক্রমেই উচ্চ হইতে উচ্চতর নৈতিক সোপানে উঠিতে থাকে, অবশেষে এই সব কর্ম্মযোগীরা আর পার্থিব রক্তমাংসের নরনারী থাকে না, নরদেহে দেবতা বা বোধিসত্ত্বে পরিণত হইয়া যায়। এই যোগসাধনা বড় কঠিন, এই ক্রমোন্নতির পথ যেন ফুরায় না; যেমন ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ রামানন্দ ভক্তির ভাবগুলি ব্যাখ্যা করিতেছেন, কিন্তু মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হইতে পারিতেছেন না, তিনি ক্রমাগত দাবি করিতেছেন “আরও কহ” অর্থাৎ আরও উঁচুতে উঠ, আরও গভীরতর হৃদয় স্তরে পৌঁছাও। বঙ্কিমের বর্ণিত আদর্শ ঠিক সেই মত কঠোর সাধনার ফল, ইহাতে সিদ্ধি অতি কম কয় জন পাইয়াছেন; ভবানন্দ জীবানন্দের মত লোক পর্যন্ত ব্রতভঙ্গ করিলেন। দেবী চৌধুরাণী “দশ বৎসর ধরিয়া বাঁধ বাঁধিয়াছিল,” কিন্তু তাহাকেও নিশি ঠাকুরাণী বলিতে বাধ্য হইলেন, “এই কি তোমার নিষ্কাম ধর্ম্ম? এই কি সন্ন্যাস? তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।”
এই নিষ্কাম ধর্ম্মের অনুশীলনের যে জীবন্ত দৃষ্টান্তগুলি বঙ্কিম অতুলনীয় তুলি দিয়া আঁকিয়াছেন, তাহা পড়িতে পড়িতে আমাদের মন এক অনির্ব্বচনীয় স্ফূর্ত্তিতে সতেজ হইয়া উঠে; আমরাও যেন ইহাদের সঙ্গে সঙ্গে উঁচু হইতেছি; নিজ জীবনে কৃচ্ছ্র সাধনা করিবার, নৈতিক উন্নতির চরমে উঠিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মনেও জাগিয়া উঠে; আবার পরক্ষণেই হতাশা ও অবসাদ আসিয়া আমাদিগকে মর্ত্ত্যে নামাইয়া দেয়। আগুনে পোড়াইয়া হাতুড়ি পিটিয়া লোহাকে যেমন ইস্পাত করা হয়, তেমনই বড় দৈন্য, বড় দুঃখ, বড় কঠোর সংযমের ভিতর দিয়া শান্তি ও জীবানন্দ, দেবী ও শ্রী গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই মহান্ আদর্শ আকাশের রামধনুর মত চিরদিন দূর হইতে মানবকে আহ্বান করিতে থাকিবে—বিশ্বমানবকে, আমাদের জাতিকে, মৃতসঞ্জীবনী সুধা দিতে থাকিবে। এই গ্রন্থগুলি পড়িতে পড়িতে মনে হয় যেন এই মর্ত্ত্যলোকের অতীত এক নূতন জগতের প্রবেশদ্বার হঠাৎ খুলিয়া গেল, তাহার ভিতর দিয়া ‘অলোক আলোকে’ উদ্ভাসিত এক