কল্পনার মায়াপুরী অল্প অল্প দেখা দিতেছে। ইহাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কাব্যের চিহ্ন; ইহার জন্যই ‘আনন্দমঠ,’ ‘দেবী চৌধুরাণী,’ ‘সীতারামে’র অমরত্ব।
একখানা প্রাচীন প্রস্তরে এই বৌদ্ধ মন্ত্রটি খোদা আছে (সহজ সংস্কৃত আকারে দিলাম):—
ত্রিণি অমৃত-পদানি সু-অনুষ্ঠিতানি
নিয়ন্তি স্বর্গম্—দম ত্যাগ অপ্রমাদঃ।
“তিনটি অমৃত-পদ মানুষকে স্বর্গে পৌছাইয়া দেয়; সে তিনটি—আত্মসংযম, স্বার্থত্যাগ, এবং স্থির সত্য বুদ্ধি।” ইহাতে গীতার শিক্ষা এক কথায় ব্যক্ত হইয়াছে; ইহাই বঙ্কিমের ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়; এই জন্যই সেগুলি পাঠকচিত্ত উদ্বেলিত করিয়া দেয়, সুখ দেয় না।
আর এক শ্রেণীর উপন্যাস আছে, অতি প্রতিভাশালী কথাশিল্পীর রচনা; তাহাতে জ্বলন্ত বর্ণে প্রবৃত্তিমার্গ চিত্রিত হইয়াছে; তাহার নায়িকা শ্রীমতী গাভী (মাদাম্ বোভারি), যেদিকে বাসনা সেই দিকে গা ঢালিয়া দিয়া যান এমন সহজে এমন সুন্দররূপে যে পাঠক-পাঠিকা তাহাতে অজ্ঞাতসারে প্রলুব্ধ হয়। বিশ্ব-সাহিত্যে এগুলি হয়তো চিরদিন পড়িবার লোক পাইবে, কিন্তু ইহারা পাঠককে স্বর্গে লইয়া যাইতে পারিবে না, এগুলি
নিয়স্তি স্বপ্নম্—
অর্থাৎ পড়িয়া আরামে ঘুম পায়, একেবারে মনে ভাবনা-চিন্তার উদ্রেক হয় না, ইহারা বিবেককে নাড়া দেয় না। বঙ্কিম সে পথে যান নাই।
আজ ৪৪ বৎসর হইল বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের গগন হইতে অপসৃত। কিন্তু তাঁহার মহাকাব্য ‘আনন্দমঠে’র নিভৃত রস যে পান করিয়াছে, সেই যেন দিব্যচক্ষে দেখিতেছে যে, আমাদের জাতীয়তায় দীক্ষার ঋষি জ্যোতিমণ্ডিত দেহে হিমাচলের শিখরে দাঁড়াইয়া সমগ্র ভারতবাসীকে ডাকিতেছেন—
স্বার্থ হ’তে জাগ, দৈন্য হ’তে জাগ,
সব জড়তা হ’তে জাগ, জাগ রে,
সতেজ উন্নত শোভাতে।
মুক্তি কোন্ পথে, এ প্রশ্নের উত্তর ইহাই।