পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম খণ্ড—দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
৩৫

 সুকুমারী মনে করিল, এটি বেশ খেলিবার জিনিস। কৌটাটি একবার বা ঁহাতে ধরিয়া দাহিন হাতে বেশ করিয়া তাহাকে চাপড়াইল, তার পর জাহিন হাতে ধরিয়া বা হাতে তাহাকে চাপড়াইল। তার পর দুই হাতে ধরিয়া টানাটানি করিল। সুতরাং কৌটাটি খুলিয়া গেল-বড়িটি পড়িয়া গেল।

  বাপের কাপড়ের উপর ছোট গুলিটি পড়িয়া গেল-সুকুমারী তাহা দেখিল, মনে করিল, এও আর একটা খেলিবার জিনিস। কৌটা ফেলিয়া দিয়া থাবা মারিয়া বড়িটি তুলিয়া লইল।

 কৌটাটি সুকুমারী কেন গালে দেয় নাই বলিতে পারি না-কিন্তু বড়িটি সম্বন্ধে কালবিলম্ব হইল না। প্রাপ্তিমাত্রেণ ভোব্য—সুকুমারী বড়িটি মুখে পুরিল। সেই সময় তাহার উপর মার নজর পড়িল।

 “কি খাইল! কি খাইল! সর্বনাশ!” কল্যাণী ইহা বলিয়া, কন্যার মুখের। ভিতর আঙ্গুল পুরিলেন। তখন উভয়েই দেখিলেন যে, বিষের কৌটা খালি পড়িয়া আছে। সুকুমারী তখন আর একটা খেলা পাইয়াছি মনে করিয়া দাঁত চাপিয়া—সবে গুটীকত দাত উঠিয়াছে—মার মুখপানে চাহিয়া হাসিতে লাগিল। ইতিমধ্যে বোধ হয়, বিষবড়ির স্বাদ মুখে কদর্য্য লাগিয়াছিল; কেন না, কিছু পরে মেয়ে আপনি দাঁত ছাড়িয়া দিল। কল্যাণী বড়ি বাহির করিয়া ফেলিয়া দিলেন। মেয়ে কাদিতে লাগিল।

 বটিকা মাটিতে পড়িয়া রহিল। কল্যাণী নদী হইতে আঁচল ভিজাইয়া জল আনিয়া মেয়ের মুখে দিলেন। অতি সকাতরে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “একটু কি পেটে গেছে?”

 মন্দটাই আগে বাপ মার মনে আসে—যেখানে অধিক ভালবাসা, সেখানে ভয়ই অধিক প্রবল। মহেন্দ্র কখন দেখেন নাই যে, বড়িটা আগে কত বড় ছিল। এখন বড়িটা হাতে লইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “বোধ হয় অনেকটা খাইয়াছে।”

 কল্যাণীরও কাজেই সেই বিশ্বাস হইল। অনেকক্ষণ ধরিয়া তিনিও বড়ি হাতে লইয়া নিরীক্ষণ করিলেন। এদিকে, মেয়ে যে দুই এক ঢোক গিলিয়াছিল, তাহারই গুণে কিছু বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইল। কিছু ছটফট করিতে লাগিল—কঁদিতে লাগিল—শেষ কিছু অবসন্ন হইয়া পড়িল। তখন কল্যাণী স্বামীকে বলিলেন, “আর দেখ কি? যে পথে দেবতায় ডাকিয়ছে, সেই পথে সুকুমারী চলিল—আমাকেও যাইতে হইবে।”