৷•
এবং এই কারণেই ‘আনন্দমঠে’র সন্তানেরা মৃত্যু পণ করিয়াছিল। “একটি গীতে” দেখিতে পাই—
গণিব। আমার এক দুঃখ, এক সন্তাপ, এক ভরসা আছে। ১২০৩ শাল হইতে দিবস গণি। যে দিন বলে হিন্দুনাম লোপ পাইয়াছে, সেই দিন হইতে দিন গণি। যে দিন সপ্তদশ অশ্বারোহী বঙ্গজয় করিয়াছিল, সেই দিন হইতে দিন গণি! হায়! কত গণিব। দিন গণিতে গণিতে মাস হয়, মাস গণিতে গণিতে বৎসর হয়, বৎসর গণিতে গণিতে শতাব্দী হয়, শতাব্দীও ফিরিয়া ফিরিয়া সাত বার গণি।
...মনে মনে আমি সেই দিন কল্পনা করিয়া কাঁদি। মনে মনে দেখিতে পাই, মার্জ্জিত বর্শাফলক উন্নত করিয়া, অশ্বপদশব্দমাত্রে নৈশ নীরব বিঘ্নিত করিয়া, যবনসেনা নবদ্বীপে আসিতেছে। কালপূর্ণ দেখিয়া নবদ্বীপ হইতে বাঙ্গালার লক্ষ্মী অন্তর্হিতা হইতেছেন।
‘আনন্দমঠে’র সন্তানসম্প্রদায় বঙ্গজননীর এই লুপ্ত স্বাধীনতা ফিরাইয়া আনিবার সাধনা করিয়াছিলেন, কিন্তু বঙ্কিম স্বীয় অপরিসীম প্রবৃত্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে বিজয়-গৌরব দিতে পারেন নাই। 'আনন্দমঠের' ট্র্যাজেডি ইহাই।
১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভেই বঙ্কিমচন্দ্র হুগলী হইতে হাওড়ায় বদলি হন; হাওড়াতে আসিয়াই স্থানীয় কলেক্টর সি.ই. বাক্লণ্ডের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধে, এবং ইহার অব্যবহিত পরেই তাঁহার পিতা যাদবচন্দ্রের মৃত্যু হয়। 'আনন্দমঠ’ এই সময়ের রচনা। কেহ কেহ উপরি-উক্ত দুই ঘটনার সহিত ‘আনন্দমঠে’র কিছু সম্পর্ক খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন।[১]
‘আনন্দমঠ' রচনা সম্পর্কে বঙ্কিম-সহোদর পূর্ণচন্দ্র লিখিয়াছেন,
বর্ষীয়ান্ খুল্লপিতামহের নিকট আমরা কয় ভ্রাতা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা প্রথম শুনি। ইঁহার গল্প করিবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।..কি প্রকারে তিল তিল করিয়া মন্বন্তর ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া বঙ্গদেশ ছারখার করিল, তাহা বিবৃত করিলেন।...এইরূপ অবস্থাতে বঙ্গে নানা প্রকার পীড়ার অবির্ভাব হইয়া, অবশেষে চুরি ডাকাতি আরম্ভ হইল।...এই গল্পটি আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু আমার অগ্রজের উহা মনে ছিল; কেন না, ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষের সময়ে ঐ গল্পটি আবার তাঁহার মুখে শুনিলাম। আমার বোধ হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অবলম্বনে কোন উপন্যাস লিখিবার তাঁহার অনেক দিন ইচ্ছা ছিল, কিন্তু যৌবনে লেখেন নাই, কিঞ্চিৎ পরিণত বয়সে ‘আনন্দমঠ' লিখিলেন।—বঙ্কিম-প্রসঙ্গ’, পৃ. ৫১-৫২।
- ↑ অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত। 'বঙ্কিমচন্দ্র' পৃ. ২৭৩।