পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৪
আনন্দমঠ

বিশেষত মা ছাড়া হইয়া অবধি কাঁদিতেছে, চরকার শব্দ শুনিয়া ভয় পাইয়া আরও উচ্চ সপ্তকে উঠিয়া কঁদিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরের ভিতর হইতে একটি সতের কি আঠার বৎসরের মেয়ে বাহির হইল। মেয়েটি বাহির হইয়াই দক্ষিণ গণ্ডে দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলি সন্নিবিষ্ট করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। “এ কি এ? দাদা চরকা কাটো কেন? মেয়ে কোথা পেলে? দাদা, তোমার মেয়ে হয়েছে না কি আবার বিয়ে করেছ কি?”

 জীবানন্দ মেয়েটি আনিয়া সেই যুবতীর কোলে দিয়া তাহাকে কীল মারিতে উঠিলেন, বলিলেন, “স্বাদরী, আমার আবার মেয়ে, আমাকে কি হেজিপেজি পেলি না কি? ঘরে দুধ আছে?”

 তখন সে যুবতী বলিল, “দুধ আছে বই কি, খাবে?”

 জীবানন্দ বলিল, “খাব।”

 তখন সে যুবতী ব্যস্ত হইয়া দুধ জ্বাল দিতে গেল। জীবানন্দ ততক্ষণ চরকা ঘেনর ঘেনর করিতে লাগিলেন। মেয়েটি সেই যুবতীর কোলে গিয়া আর কাদে না। মেয়েটি কি ভাবিয়াছিল বলিতে পারি না বোধ হয় এই যুবতীকে ফুল্লকুসুমতুল্য সুন্দরী দেখিয়া মা মনে করিয়াছিল। বোধ হয় উননের তাপের আঁচ মেয়েটিকে একবার। লাগিয়াছিল, তাই সে একবার কাঁদিল। কান্না শুনিবামাত্র জীবানন্দ বলিলেন, “ও নিমি! ও পোড়ারমুখি! ও হনুমানি! তোর এখনও দুধ জ্বাল হলো না?” নিমি বলিল, “হয়েছে।” এই বলিয়া সে পাথর বাড়ীতে দুধ ঢালিয়া জীবানন্দের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল। জীবানন্দ কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “ইচ্ছা করে যে, এই তপ্ত দুধের বাটী তোর গায়ে ঢালিয়া দিই— তুই কি মনে করেছি আমি খাব না কি?”

 নিমি জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কে খাবে?”

 জীবা। ঐ মেয়েটি খাবে দেখছিস্ নে, ঐ মেয়েটিকে দুধ খাওয়া।

 নিমি তখন আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া মেয়েকে কোলে শোয়াইয়া ঝিনুক লইয়া তাহাকে দুধ খাওয়াইতে বসিল। সহসা তাহার চক্ষু হইতে ফোটাকতক জল পড়িল। তাহার একটি ছেলে হইয়া মরিয়া গিয়াছিল, তাহারই ঐ ঝিনুক ছিল। নিমি তখনই হাত দিয়া জল মুছিয়া হাসিতে হাসিতে জীবানন্দকে জিজ্ঞাসা করিল,—

 “হ্যাঁ দাদা, কার মেয়ে দাদা?”

 জীবানন্দ বলিলেন, “তোর কি রে পোড়ারমুখী?”