৷৴•
জয়দেবের “ধীয়সমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী” কবিতাটা তাঁহার বড় প্রিয় ছিল। কি বাল্যে, কি কৈশোরে, কি যৌবনে, এই কবিতাটা তাঁহার মুখে শুনিতাম; যখন নিষ্কর্মা হইয়া বসিতেন, বাহিরের লোক কেহ ঘরে থাকিত না, তখন উহা আওড়াইতেন। ঐ কবিতাটা যে তাঁহার প্রিয় ছিল, তাহার স্মৃতি ‘আনন্দমঠে’ রাখিয়া গিয়াছেন,...
আর একটা গীত তাঁহার বড় প্রিয় ছিল। বাল্যকালে আপনি এই গীতটীতে মাতিয়াছিলেন, পরে আনন্দমঠের সন্তানদিগকেও এই গীতে মাতাইয়াছিলেন। একদিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে এই গীত তিনি প্রথম শুনিলেন।...এক বৈষ্ণব খঞ্জনী বাজাইয়া সদর রাস্তায় এই গানটা গাহিতেছিল, আমি তখন জাগ্রৎ- মধুর কণ্ঠে এই রাত্রে কে গীত গাহিতেছে শুনিয়া অগ্রজকে উঠাইলাম; গান শুনা যাইতেছিল না, অগ্রজ একটা জানালা খুলিয়া দিলে গীতটা শুনিতে পাইলাম—“হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দসৌরে।” বৈষ্ণব এই গীতটী গাহিতে গাহিতে ঠাকুর বাটীর দিকে চলিয়া গেল। বঙ্কিমচন্দ্র “হরে মুরারে মধুকৈটভারে” আওড়াইতে আওড়াইতে জানালা বন্ধ করিলেন।
‘আনন্দমঠ' রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র কিছু কাল কলিকাতায় বাসা ভাড়া করিয়া অবস্থান করিতেছিলেন। চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় লিখিয়াছেন,
বউবাজার ষ্ট্রীটের যে বাড়ীর সম্মুখের খণ্ডে এক্ষণে মুখুৰ্জী কোম্পানির হোমিওপেথিক ঔষধের দোকান দেখিতে পাওয়া যায় দিন কতক তিনি সেই বাড়ীতে ছিলেন।...এক দিন বৈকালে সেই বাড়ীতে গেলাম। বঙ্কিমবাবু আনন্দমঠের পাণ্ডুলিপি পড়িয়া শুনাইতে আরম্ভ করিলেন।[১]
অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত লিখিয়াছেন,
বঙ্কিমের পিতৃগৃহ বর্ত্তমানসময়ে নিতান্ত ভগ্নাবস্থাগ্রস্ত। তাহার নিজ নির্ম্মিত বৈঠকখানাও ঘোরতর দুর্দশাগ্রস্ত। ...ঐ গৃহে বসিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দে মাতরম্” সঙ্গীত ও 'কৃষ্ণকান্তের উইল’ রচিত হইয়াছিল।
-বঙ্কিমচন্দ্র’ পৃ. ৩২-৩৩।
হুগলীতে অবস্থানকালে যে ‘আনন্দমঠে’র গোড়াপত্তন হইয়াছিল, অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাহার সাক্ষ্য দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন,
যখন আনন্দমঠ সূতিকাগারে, তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিমবাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ, বড় টেবল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি বন্দে মাতরম্’
- ↑ 'প্রদীপ’—আষাঢ়, ১৩০৫, পৃ. ২১৮-১৯।