পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬০
আনন্দমঠ

 “আমি মেয়ের বাপের কথা জিজ্ঞাসা করি নাই-মার কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছি।”

 নিমাই উচিত শাস্তি পাইয়া অপ্রতিভ হইয়া বলিল,

 “কার মেয়ে কি জানি ভাই, দাদা কোথা থেকে কুড়িয়ে মুড়িয়ে এনেছে, তা জিজ্ঞাসা করবার ত অবসর হলো না! তা এখন মন্বন্তরের দিন, কত লোক ছেলে পিলে পথে ঘাটে ফেলিয়া দিয়া যাইতেছে; আমাদের কাছেই কত মেয়ে, ছেলে বেচিতে আনিয়াছিল, তা পরের মেয়ে ছেলে কে আবার নেয়?” (আবার সেই চক্ষে সেইরূপ জল আসিল—নিমি চক্ষের জল মুছিয়া আবার বলিতে লাগিল)।

 “মেয়েটি দিব্য সুন্দর, নাদুস্ নুদুস্ উঁদপনা দেখে দাদার কাছে চেয়ে নিয়েছি।”

 তার পর শান্তি অনেকক্ষণ ধরিয়া নিমাইয়ের সঙ্গে নানাবিধ কথোপকথন করিল। পরে নিমাইয়ের স্বামী বাড়ী ফিরিয়া আসিল দেখিয়া শান্তি উঠিয়া আপনার কুটীরে গেল। কুটীরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া উননের ভিতর হইতে কতকগুলি ছাই বাহির করিয়া তুলিয়া রাখিল। অবশিষ্ট ছাইয়ের উপর নিজের জন্য যে ভাত রান্না ছিল, তাহা ফেলিয়া দিল। তার পরে দাড়াইয়া দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া আপনা আপনি বলিল, “এত দিন যাহা মনে করিয়াছিলাম, আজি তাহা করিব। যে আশায় এত দিন করি নাই, তাহা সফল হইয়াছে। সফল কি নিষ্ফল—নিস্ফল। এ জীবনই নিস্ফল! যাহা সঙ্কল্প করিয়াছি, তাহা করিব। একবারেও যে প্রায়শ্চিত্ত, শতবারেও তাই।”

  এই ভাবিয়া শান্তি ভাতগুলি উননে ফেলিয়া দিল। বন হইতে গাছের ফল পাড়িয়া আনিল। অন্নের পরিবর্তে তাহাই ভোজন করিল। তার পর তাহার যে ঢাকাই শাড়ীর উপর নিমাইমণির চোট, তাহা বাহির করিয়া তাহার পাড় ছিড়িয়া ফেলিল। বস্ত্রের যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, গেরিমাটিতে তাহা বেশ করিয়া রঙ করিল। বস্তু রঙ করিতে, শুকাইতে সন্ধ্যা হইল। সন্ধ্যা হইলে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, অতি চমৎকার ব্যাপারে শান্তি ব্যাপৃত হইল। মাথার রুক্ষ আগুফলম্বিত কেশদামের কিয়দংশ কঁচি দিয়া কাটিয়া পৃথক্ করিয়া রাখিল। অবশিষ্ট যাহা মাথায় রহিল, তাহা বিনাইয়া জটা তৈয়ারি করিল। রুক্ষ কেশ অপূৰ্ববিদ্যাসবিশিষ্ট জটাভারে পরিণত হইল। তার পর সেই গৈরিক বসনখানি অর্ধেক ছিড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল। ঘরে একখানি ক্ষুদ্র দর্পণ ছিল, বহুকালের পর শান্তি সেখানি বাহির করিল; বাহির করিয়া দর্পণে আপনার বেশ আপনি দেখিল। দেখিয়া বলিল, “হায়! কি করিয়া কি করি।” তখন দর্পণ ফেলিয়া দিয়া, যে চুলগুলি কাটা