সত্যানন্দ বিস্মিত, ভীত এবং স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “এ কি; তুমি দেবী, না মানবী?”
শান্তি করজোড়ে বলিল, “আমি সামান্যা মানবী, কিন্তু আমি ব্রহ্মচারিণী।”
সত্য। তাই বা কিসে? তুমি কি বালবিধবা? না, বালবিধবারও এত বল হয়; কেন না, তাহারা একাহারী।
শান্তি। আমি সধবা।
সত্য। তোমার স্বামী নিরুদ্দিষ্ট?
শান্তি। উদ্দিষ্ট। তাঁহার উদ্দেশেই আসিয়াছি। সহসা মেঘভাঙ্গা রৌদ্রের ন্যায় স্মৃতি সত্যানন্দের চিত্তকে প্রভাসিত করিল। তিনি বলিলেন, “মনে পড়িয়াছে, জীবানন্দের স্ত্রীর নাম শান্তি। তুমি কি জীবানন্দের ব্রাহ্মণী?”
এবার জটাভারে নবীনানন্দ মুখ ঢাকিল। যেন কতকগুলা হাতীর শুড়, রাজীবরাজির উপর পড়িল। সত্যানন্দ বলিতে লাগিলেন, “কেন এ পাপাচার করিতে আসিলে?”
শান্তি সহসা জটাভার পৃষ্ঠে বিক্ষিপ্ত করিয়া উন্নত মুখে বলিল,
“পাপাচরণ কি প্রভু? পত্নী স্বামীর অনুসরণ করে, সে কি পাপাচরণ? সন্তান- ধর্মশাস্ত্র যদি একে পাপাচরণ বলে, তবে সন্তানধর্ম অধর্ম। আমি তাহার সহধর্মিণী, তিনি ধর্মাচরণে প্রবৃত্ত, আমি তাহার সঙ্গে ধর্মাচরণ কষিতে আসিয়াছি।”
শান্তির তেজস্বিনী বাণী শুনিয়া, উন্নত গ্রীবা, স্ফীত বক্ষ, কম্পিত ধর এবং উজ্জ্বল অথচ অদ্ভুত চক্ষু দেখিয়া সত্যানন্দ প্রীত হইলেন। বলিলেন,
“তুমি সাধ্বী। কিন্তু দেখ মা – পত্নী কেবল গৃহধর্ম্মেই সহধর্মিণী-বীরধর্ম্মে রমণী কি?”
শান্তি। কোন্ মহাবীর অপত্নীক হইয়া বীর হইয়াছেন? রাম সীতা নহিলে কি বীর হইতেন? অর্জুনের কতগুলি বিবাহ গণনা করুন দেখি। ভীমের যত বল, ততগুলি পত্নী। কত বলিব? আপনাকে বলিতেই বা কেন হইবে?
সত্য। কথা সত্য, কিন্তু রণক্ষেত্রে কোন্ বীর জায়া লইয়া আইসে?
শান্তি। অর্জুন যখন যাদবী সেনার সহিত অন্তরীক্ষ হইতে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কে তাঁহার রথ চালাইয়াছিল? দ্রৌপদী সঙ্গে না থাকিলে, পাণ্ডব কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুঝিত?