পাতা:আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা - প্রবীর ঘোষ.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কার্য-কারণ-এর শৃঙ্খলা ইত্যাদি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছেন এবং সেই রহস্যের গভীরে ডুবে থাকতে চেয়েছেন। এখানেই তিনি তাঁর ঈশ্বর বিষয়ে ধ্যান-ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর কথায়, "আমাদের অভিজ্ঞতার জগতে প্রকাশমান এক উচ্চতর মনের অস্তিত্বে এই যে গভীর অনুভূতি মাখানো পরম বিশ্বাস, এই-ই হল ঈশ্বর সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা।” [ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২৬২|

 এরপর আমরা নিশ্চয়ই বুঝে নিতে পারি, আইনস্টাইন কোনও সৃষ্টিছাড়া, ব্যাখ্যার অতীত, অলৌকিক ঘটনা বা ক্ষমতার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখেননি। বরং তিনি ঈশ্বরকে দেখেন সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহা, কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মচালিত বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। তাঁর ধারণার নিরাসক্ত গাণিতিক ঈশ্বর বস্তুবিশ্বে লীন হয়ে আছেন, প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের নিখুঁত ছন্দের মধ্যে দিয়ে, তাঁর প্রকাশ ঘটেছে।

 আর এখানেই এসে পড়ে এক অনিবার্য প্রশ্ন। প্রাকৃতিক নিয়মকানুনই যদি ঈশ্বর হয়, আর তা যদি সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহাই হয়, তবে তাকে নিছক ‘প্রাকৃতিক নিয়মকানুন' না বলে 'ঈশ্বর' আখ্যা দিতে যাবার প্রয়োজনটা কী? উত্তরটা শোনা যাক আধুনিককালের একজন প্রথম সারির খ্যাতিমান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের কাছ থেকে। তাঁর কথায়, “বিজ্ঞানী ও অন্যান্যর। মাঝে মাঝে 'ঈশ্বর' শব্দটাকে এমন এক বিমূর্ত ও নিরাস অর্থে ব্যবহার করেন যে তাকে প্রকৃতির নিয়ম থেকে আলাদা করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন যে তিনি বিশ্বাস করেন “স্পিনোজার ঈশ্বরকে, যিনি সমগ্র অস্তিত্বের ছান্দসিক নিয়মিতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন, কিন্তু যিনি মানুষের কাজকর্ম ও ভাগ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সেই ঈশ্বরকে নয়।” [ড্রিমস অফ এ ফাইনাল থিয়োরি, পৃষ্ঠা ১৯৬|

 বিষয়টা আরও একটু পরিষ্কার করতে আরও দু'একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। 'দি ইকোনমিক টাইমস' পত্রিকায় (১৮ নভেম্বর '৯৫) আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি শেষ করা হয় এভাবে—"বিজ্ঞানই প্রবীরের ঈশ্বর"। এই 'ঈশ্বর' প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দেওয়া ঈশ্বর সংজ্ঞায় আবদ্ধ নয় যেমনটা আবদ্ধ নয় আইনস্টাইনের ঈশ্বর। আমার বান্ধবী মিস্টুন একবার আমাকে বলেছিলেন, “কেউ যদি বলেন, তাঁর কাছে প্রেমই ঈশ্বর, ক্ষতি কী? এই প্রেম মনের এক গভীর অনুভূতি। তাঁর এই ঈশ্বর মানুষের প্রার্থনা পূরণে, পাপ-পুণা নির্ধারণে, ভাগ্য ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে না।”

 আইনস্টাইনের 'ঈশ্বর' কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারণার ঈশ্বর না হয়ে, হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞান বা ‘প্রেম'-এর প্রতীকের মতই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়কর নিয়মশৃঙ্খলার প্রতীক। এর বাড়তি কিছু নয়।

O

আইনস্টাইনের 'ঈশ্বর' কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারণার ঈশ্বর না

৫৭