পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- পূর্বে ফুলকিয়া বইহার ও লবটুলিয়া হইতে পশ্চিমে মুঙ্গের জেলার সীমানা পর্যন্ত সারা জঙ্গল-মহালের মধ্যে যেখানে যত খাল, ডোবা, কুণ্ডী অর্থাৎ বড় জলাশয় ছিল- সব গেল শুকাইয়া। কুয়া খুঁড়িলে জল পাওয়া যায় না- যদি বালির উনুই হইতে কিছু কিছু জল ওঠে, ছোট এক বালতি জল কুয়ায় জমিতে এক ঘণ্টার উপর সময় লাগে। চারিধারে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে। পূর্বে একমাত্র কুশী নদী ভরসা-সে আমাদের মহালের পূর্বতম প্রান্ত হইতে সাত আট মাইল দূরে বিখ্যাত মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের ওপারে। আমাদের জমিদারি ও মোহনপুরা অরণ্যের মধ্যে একটা ছোট পাহাড়ি নদী নেপালের তরাই অঞ্চল হইতে বহিয়া আসিতেছে-কিন্তু বর্তমানে শুধু শুষ্ক বালুময় খাতে তাহার উপলঢাকা চরণচিহ্ন বিদ্যমান। বালি খুঁড়িলে যে জলটুকু পাওয়া যায়, তাহারই লোভে কত দূরের গ্রাম হইতে মেয়েরা কলসি লইয়া আসে ও সারা দুপুর বালি-কাদা ছানিয়া আধ-কলসিটাক ঘোলা জল লইয়া বাড়ি ফেরে।

 কিন্তু পাহাড়ি নদী- স্থানীয় নাম মিছি নদী- আমাদের কোনো কাজে আসে না- কারণ আমাদের মহাল হইতে বহু দূরে। কাছারিতেও কোনো বড় ইঁদারা নাই-ছোট যে বালির পাতকুয়াটি আছে, তাহা হইতে পানীয় জলের সংস্থান হওয়াই বিষম সমস্যার কথা দাঁড়াইল। তিন বালতি জল সংগ্রহ করিতে দুপুর ঘুরিয়া যায়।

 দুপুরে বাহিরে দাঁড়াইয়া তাম্রাভ অগ্নিবর্ষী আকাশ ও অর্ধশুষ্ক বনঝাউ ও লম্বা ঘাসের বন দেখিতে ভয় করে- চারিধার যেন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে, মাঝে মাঝে আগুনের হল্কার মতো তপ্ত বাতাস সর্বাঙ্গ ঝলসাইয়া বহিতেছে- সূর্যের এ রূপ, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রের এ ভয়ানক রুদ্র রূপ কখনো দেখি নাই, কল্পনাও করি নাই। এক-এক দিন পশ্চিম দিক হইতে বালির ঝড় বয়- এ সব দেশে চৈত্র-বৈশাখ মাস পশ্চিমে বাতাসের সময়- কাছারি হইতে একশ’ গজ দূরের জিনিস ঘন বালি ও ধূলিরাশির আড়ালে ঢাকিয়া যায়।