পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

 শীত শেষ হইয়া বসন্ত পড়িয়াছে।

 আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে হোলির সময় একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম্য মেলা বসে, এবার সেখানে যাইব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম। বহু লোকের সমাগম অনেক দিন দেখি নাই, এদেশের মেলা কি রকম জানিবার একটা কৌতূহলও ছিল। কিন্তু কাছারির লোকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিল, পথ দুর্গম ও পাহাড়-জঙ্গলে ভর্তি, উপরন্তু গোটা পথটার প্রায় সর্বত্রই বাঘের ও বন্যমহিষের ভয়, মাঝে মাঝে বস্তি আছে বটে, কিন্তু সে বড় দূরে দূরে, বিপদে পড়িলে তাহারা বিশেষ কোনো উপকারে আসিবে না, ইত্যাদি।

 জীবনে কখনো এতটুকু সাহসের কাজ করিবার অবকাশ পাই নাই, এই সময়ে এইসব জায়গায় যতদিন আছি যাহা করিয়া লইতে পারি, বাংলা দেশে ও কলিকাতায় ফিরিয়া গেলে কোথায় পাইব পাহাড় জঙ্গল, কোথায় পাইব বাঘ ও বন্যমহিষ? ভবিষ্যতের দিনে আমার মুখে গল্পশ্রবণনিরত পৌত্র-পৌত্রীদের মুখ ও উৎসুক তরুণ দৃষ্টি কল্পনা করিয়া মুনেশ্বর মাহাতো, পাটোয়ারী ও নবীন-বাবু মুহুরীর সকল আপত্তি উড়াইয়া দিয়া মেলার দিন খুব সকালে ঘোড়া করিয়া রওনা হইলাম। আমাদের মহালের সীমানা ছাড়াইতেই ঘণ্টা-দুই লাগিয়া গেল, কারণ পূর্ব-দক্ষিণ সীমানাতেই আমাদের মহালের জঙ্গল বেশি, পথ নাই বলিলেও চলে, ঘোড়া ভিন্ন অন্য কোনো যানবাহন সে পথে চলা অসম্ভব, যেখানে সেখানে ছোট-বড় শিলাখণ্ড ছড়ানো, শাল-জঙ্গল, দীর্ঘ কাশ ও বনঝাউ-এর বন, সমস্ত পথটা উঁচু-নিচু, মাঝে মাঝে উঁচু বালিয়াড়ি রাঙা মাটির ডাঙা, ছোট পাহাড়, পাহাড়ের উপর ঘন কাঁটাগাছের জঙ্গল। আমি যদৃচ্ছাক্রমে কখনো দ্রুত, কখনো ধীরে অশ্বচালনা করিতেছি, ঘোড়াকে কদম চালে ঠিক চালানো সম্ভব