পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফুলের বন, সঙ্গে সঙ্গে আছে চড়া রৌদ্রের কম্পমান তাপ-তরঙ্গ। দিক্ ভুল হইতে বেশিক্ষণ লাগে না আনাড়ি লোকের পক্ষে।

 ঘোড়ার মুখ আবার ফিরাইলাম। হুঁশিয়ার হইয়া গন্তব্যস্থানের অবস্থান নির্ণয় করিয়া একটা দিক্চিহ্ন দূর হইতে আন্দাজ করিয়া বাছিয়া লইলাম। অকূল সমুদ্রে জাহাজ ঠিক পথে চালনা, অনন্ত আকাশে এরোপ্লেনের পাইলটের কাজ করা আর এইসব অজানা সুবিশাল পথহীন বনপ্রান্তরে অশ্বচালনা করিয়া তাহাকে গন্তব্যস্থানে লইয়া যাওয়া প্রায় একই শ্রেণীর ব্যাপার। অভিজ্ঞতা যাঁহাদের আছে, তাঁহাদের এ কথার সত্যতা বুঝিতে বিলম্ব হইবে না।

 আবার রৌদ্রদগ্ধ নিষ্পত্র গুল্মরাজি, আবার বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ, আবার অনাবৃত শিলাস্তূপসদৃশ প্রতীয়মান গণ্ডশৈলমালা, আবার রক্তপলাশের শোভা। বেলা বেশ চড়িল; জল খাইতে পাইলে ভালো হইত, ইহার মধ্যেই মনে হইল; কারো নদী ছাড়া এ পথে কোথাও জল নাই, জানি; এখনো আমাদের জঙ্গলেরই সীমা কতক্ষণে ছাড়াইব ঠিক নাই, কারো নদী তো বহুদূর-এ চিন্তার সঙ্গে তৃষ্ণা যেন হঠাৎ বাড়িয়া উঠিল।

 মুকুন্দি চাকলাদারকে বলিয়া দিয়াছিলাম আমাদের মহালের সীমানায় সীমানাজ্ঞাপক বাবলা কাঠের খুঁটি বা মহাবীরের ধ্বজার অনুরূপ যাহা হয় কিছু পুঁতিয়া রাখে। এ সীমানায় কখনো আসি নাই, দেখিয়া বুঝিলাম চাকলাদার সে আদেশ পালন করে নাই। ভাবিয়াছে, এই জঙ্গল ঠেলিয়া কলিকাতার ম্যানেজারবাবু আর সীমানা পরিদর্শনে আসিয়াছেন, তুমিও যেমন! কে খাটিয়া মরে? যেমন আছে তেমনিই থাকুক। পথের কিছুদূরে আমাদের সীমানা ছাড়াইয়া এক জায়গায় ধোঁয়া উঠিতেছে দেখিয়া সেখানে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে একদল লোক কাঠ পুড়াইয়া কয়লা করিতেছে-এই কয়লা তাহারা গ্রামে গ্রামে শীতকালে বেচিবে। এদেশের শীতে গরিব লোকে মালসায় কয়লার আগুন করিয়া শীত নিবারণ করে; কাঠকয়লা চার সের পয়সায় বিক্রি হয়, তাও কিনিবার পয়সা অনেকের জোটে না,