পাতা:ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ।

যে প্রদেশে প্রবেশ করিতেছি, উহা যেন আরও বিষাদ-মধুর—একেবারেই যেন আমাদের দেশের মত। এই চতুর্দিকস্থ ভারতীয় অরণ্যের ভাবটি যদিও আমার অন্তরের অন্তস্তলে গৃঢ়ভাবে জাগিতেছে, তবু যেন আমার মনে হইতেছে, আমি Saintonge কিংবা Aunisএর ওকবৃক্ষের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি; তাই আমি এই অরণ্যের মধ্য দিয়া বিশ্রভাবে চলিতেছি।

 আমার বিশ্বাস ছিল, আমি এখানে সম্পূর্ণরূপে একাকী, তাই হঠাৎ আমার পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড মনুষ্যমূর্ত্তি দেখিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম। তাহার হস্তদ্বয় কটিদ্বেশে লগ্ন ও মস্তক আনত বুদ্ধের এই পাষাণ প্রতিমাটি দুই সহস্র বৎসর হইতে এইখানেই বসিয়া আছে!

 তাহার মুখের কাছে আসিয়া, অন্ধকারের মধ্যে দেখিলাম, সেই তার চির-নত দৃষ্টি, সেই তার চিরন্তন স্মিত-হাস্য!

 এই সময়ে বিশেষতঃ এই চন্দ্রালোকে, যখন মন্দিরের চূড়াগুলি জঙ্গলের সুদূরপ্রান্ত পর্যন্ত, স্বকীয় ছায়া প্রসারিত করে, তখন ফি এক পবিত্র ধর্মভাব-রঞ্জিত শান্তিরসের আবির্ভাব হয়। আজ এই সন্ধ্যাকালে চন্দ্রমা সুনীলকিরণ বর্ষণ করিতেছেন। আজ একটি রাত্রি আমি এই অরণ্যে যাপন করিলাম, আর সৌভাগ্যক্রমে আজিকার রাত্রিতেই দিগ্বিদিক স্বর্গীয় আলোকে প্লাবিত হইল। আমাদের জুলাই মাসের তরল স্বচ্ছ উষ্ণরাত্রির কথা মনে পড়িতেছে। কেবল প্রভেদ এইমাত্র মনে হয়, এখানে গ্রীষ্মকালের যেন অন্ত নাই। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে, পদক্ষুন্ন-পথবিশিষ্ট সুন্দর শাদল-ভূমির উপরে—আকাশের যে অংশ তরুশাখায় ঢাকা পড়ে নাই, সেই নভোদেশে—এমন কি সর্ব্বত্রই এখন আলোকে আলোকময়।

 এই সময় কীটদিগের সুতীব্র নৈশ সঙ্গীতে চতুর্দিক অনুরণিত হইলেও, যতই আমি অরণ্য-গভীরে প্রবেশ করিতেছি, ততই যেন নিস্তব্ধতার মধ্যে ক্রমশ মগ্ন হইয়া যাইতেছি।