পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দরকার নেই, আমাদের খাবার কই? চিঁড়ে-মুড়কি? আমরা হচ্চি ডোম ডোকলা; ছেচতলায় বসে চিঁড়ে-মুড়কি খাবো, হাত তুলি বলতি বসতি বাড়ি যাবো। সত্যি না কি?

 নিলু মুখ টিপে টিপে হাসছিল। এবার সামনে এসে বললে-খাক গো, নাগরের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, আর বলো না দিদি। আমারই যেন কষ্ট হচ্ছে। উনি আবার যা তা কথা শুনতি পারেন না। বলেন—কি একটা সংস্কৃতো কথা, আমার মুখ দিয়ে কি আর বেরোয় দিদি?

 ভবানী বাঁড়ুয্যের বাড়িতে একখানা মাত্র চারচালা ঘর, আর উত্তরের পোঁতায় একখানা ছোট দু’চালা ঘর। ছোট ঘরটাতে ভবানী বড় যে নিজে থাকেন এবং অবসর সময়ে শাস্ত্রপাঠ করেন বসে। তিলু এই ঘরেই থাকে তাঁর সঙ্গে, বিলু আর নিলু থাকে বড় চারচালা ঘরটাতে। খোকা ছোট ঘরে তার মার সঙ্গে থাকে অবিশ্যি। নিলু হঠাৎ ভবানী বাঁড়ুয্যের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বড় ঘরটাতে। খোকা সেখানে শুয়ে ঘুমুচ্চে। ভবানী দেখলেন খোকা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, টানা টানা চোখ দুটি নিদ্রিত নারায়ণের মত নিমীলিত। ভবানী বড়য্যে শিশুকে ওঠাতে গেলে নিলু বলে উঠলো—ফুটকে উঠিও না বলে দিচ্চি। এমন কাদবে তখন, সামলাবে কেডা?

 ভবানী তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় উঠিয়ে বলেন, খোকা চোখ বুজিয়েই চুপ করে বসে রইল, নড়লেও না চড়লেও না-কি সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। কি নিষ্পাপ মুখখানা: সমগ্র জগং-রহস্য যেন এই শিশুর পেছনে অসীম প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। মহর্লোক থেকে নিম্নতম ভূমি পর্যন্ত ওর পাদস্পর্শের ও খেয়ালী লীলার জন্যে উৎসুক হয়ে আছে, তারায় তারায় সে আশা-নিরাশার বাণী জ্যোতির অক্ষরে লেখা হয়ে গেল।

 নিলু বললে-ওর ঘাড় ভেঙে যাবে ঘাড় ভেঙে যাবে—কি আপনি? কচি ঘাড় না?

 বিলু ছুটে এসে থোকাকে আবার শুইয়ে দিলে। সে যেমন নিঃশব্দে বসেছিল, তেমনি নিঃশব্দে ঘুমুতে লাগলো।

১৩১