পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মধ্যে নামা যুক্তিসঙ্গত হবে কি? হেঁটে বাড়ি যেতে হবে ডাঙায় ডাঙায়। পথও তো সে চেনে না।

 সাঁতার দিয়ে ডাঙার দিকে সে এল এগিয়ে। বন্যেবুড়ো গাছের সারি সেখানে নত হয়ে পড়েচে নদীর জলের উপর ঝুকে, গাছে-পালায় লতায় পাতায় নিবিড়তর জড়াজড়ি, বন্য বিহঙ্গের দল জুটে কিচ কিচ্‌ করচে ঝোপের পাকা তেলাকুচো ফল খাওয়ার লোভে। বনের মধ্যে শুকনো পাতার ওপর কিসের খস্‌খস্‌ শব্দ—কি একটা জানোয়ার যেন ছুটে পালালো, বোধ হয় খেঁকশিয়ালী।

 ডাঙায় ওঠবার আগে হাতের বাউটি জোড়া উঠিয়ে নিলে কব্জির দিকে, সিক্ত বসন ভালো ক’রে এঁটে পরে, কালো চুলের রাশ কপালের ওপর থেকে দু’পাশে সরিয়ে যখন সে ডান পা খানা তুলেচে বালির ওপর, অমনি একটা ঝিনুকের ওপর পা পড়লো ওর। ঝিনুকটা সে পায়ের তলা থেকে কুড়িয়ে শক্ত ক’রে মুঠি বেঁধে নিলে। তারপর ভয়ে ভয়ে বনের মধ্যেকার সুঁড়ি পথ দিনে বিছুটিলতার কর্কশ স্পর্শ গায়ে মেখে, সেয়াকুল-কাঁটায় শাড়ির প্রশ্ন ছিড়ে অতিকষ্টে এসে সে গ্রাম-প্রান্তের কাওরাপাড়ার পথে পা দিলে। কাওরাদের বাড়ির ঝি-বৌয়ের দল ওর দিকে কৌতুহলের দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলে। খানিকটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতেও বটে। ব্রাহ্মণপাড়ায় বৌ, একা কোথায় এসেছিল এতদূর? ভিজে কাপড়, ভিজে চুলে?

 বাড়ি পৌঁছে নিস্তারিণী দেখলে বাড়িতে ও পাড়ায় গোলমাল চলেচে, কান্নাকাটির রব শোনা যাচ্চে তার শাশুড়ীর, পিসশাশুড়ীর। সে জলে ডুবে গিয়েচে বা তাকে কুমীরে নিয়ে গিয়েচে এই হয়েচে সিদ্ধান্ত। ফিরতে দেরি হচ্চে দেখে যারা স্নানের ঘাটে ওকে দৌড়ে দেখতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে বলেচে কোনো চিহ্নই ওর নেই কোনো দিকে। ওকে দেখে সবাই খুব খুশি হোলো। শাশুড়ী এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন। প্রতিবেশিনীরা এসে স্নেহের অনুযোগ করলে কত রকম।

 ভাত খাওয়ার পরে ননদ সুধামূখীকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরের পেছনের কুলতলায় সেই ঝিনুকখানা খুললে নিস্তারিণী। ঝিনুকের শাঁক দুজনে ঘেঁটে

২৫০