পঞ্চম পরিচ্ছেদ হিরন্ময়ী যুবতী এবং সুন্দরী—একাকিনী এক গৃহে শয়ন করা ভাল নহে। আপদও আছে—কলঙ্কও আছে। অমলা নামে এক গোপকস্তা হিরন্ময়ীর প্রতিবাসিনী ছিল । সে বিধবা–তাহার একটি কিশোরবয়স্ক পুত্র এবং কয়েকটি কন্যা। তাহার যৌবনকাল অতীত হইয়াছিল। সচ্চরিত্রা বলিয়া তাহার খ্যাতি ছিল। হিরন্ময়ী রাত্রিতে আসিয়া তাহার গৃহে শয়ন করিতেন। এক দিন হিরন্ময়ী অমলার গুহে শয়ন করিতে আসিলে পর, অমলা তাহাকে কহিল, “সংবাদ শুনিয়াছ, পুরন্দর শ্রেষ্ঠ না কি আট বৎসরের পর নগরে ফিরিয়া আসিয়াছে।” শুনিয়া হিরন্ময়ী মুখ ফিরাইলেন-চক্ষুর জল অমলা না দেখিতে পায়। পৃথিবীর সঙ্গে হিরন্ময়ীর শেষ সম্বন্ধ ঘুচিল। পুরন্দর তাহাকে ভুলিয়া গিয়াছে। নচেৎ ফিরিত না । পুরন্দর এক্ষণে মনে রাখুক বা ভুলুক, তাহার লাভ বা ক্ষতি কি ? তথাপি যাহার স্নেহের কথা ভাবিয়া যাবজ্জীবন কাটাইয়াছেন, সে ভুলিয়াছে ভাবিতে হিরন্ময়ীর মনে কষ্ট হইল। হিরন্ময়ী একবার ভাবিলেন—“ভুলেন নাই—কতকাল আমার জন্য বিদেশে থাকিবেন ? বিশেষ তাহাতে র্তাহার পিতার মৃত্যু হইয়াছে—আর দেশে না আসিলে চলিবে কেন ?" আবার ভাবিলেন, “আমি কুলটা সন্দেহ নাই—নহিলে পুরন্দরের কথা মনে করি কেন ?” অমলা কহিল, “পুরন্দরকে কি তোমার মনে পড়িতেছে না? পুরনার শচীস্বত শেঠির ছেলে।” হি। চিনি। অ। তা সে ফিরে এসেছে—কত নৌকা যে ধন এনেছে, তাহা গুণে সংখ্যা করা যায় না। এত ধন না কি এ তামলিপে কেহ কখন দেখে নাই । হিরন্ময়ীর হৃদয়ে রক্ত একটু খর বহিল। র্তাহার দারিদ্র্যদশা মনে পড়িল, পুর্ব্বসম্বন্ধও মনে পড়িল। দারিদ্র্যের জাল বুড় জালা। তাহার পরিবর্তে এই অতুল ধনরাশি হিরন্ময়ীর হইতে পারিত, ইহা ভাবিয়া যাহার খর রক্ত না বহে, এমন স্ত্রীলোক অতি অল্প আছে। হিরন্ময়ী ক্ষণেক কাল অন্যমনে থাকিয়৷ পরে অন্য প্রসঙ্গ তুলিল। শেষ শয়নকালে জিজ্ঞাসা করিল, “অমলে, সেই শ্রেষ্টিপুত্রের বিবাহ হইয়াছে ?” অমলা কহিল, “না, বিবাহ হয় নাই।” হিরন্ময়ীর ইন্দ্রিয় সকল অবশ হইল। সে রাত্রিতে আর কোন কথা হইল না ।
পাতা:ইন্দিরা-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১১৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।