পাঠভেদ ‘ইন্দিরা'র প্রথম ও পঞ্চম সংস্করণে এত পার্থক্য যে, পাঠভেদ দেওয়া অসম্ভব। বস্তুতঃ পঞ্চম সংস্করণকে সম্পূর্ণ নূতন উপন্যাস বলা চলে। বঙ্কিমচন্দ্র “পঞ্চমবারের বিজ্ঞাপনে”ও তাহ স্বীকার করিয়াছেন । প্রথম সংস্করণে ইন্দিরা একটি বড় গল্প মাত্র (পৃষ্ঠা ৪৫ ) ছিল, আমরা “পাঠভেদে” সেইটি সম্পূর্ণ মুদ্রিত করিলাম।– প্রথম পরিচ্ছেদ । অনেক দিনের পর আমি শ্বশুর বাড়ী যাইতেছিলাম। আমি উনিশ বৎসরে পড়িয়াছিলাম, তথাপি এ পর্য্যস্ত শ্বশুরের ঘর করি নাই। তাহার কারণ, আমার পিতা ধনী, শ্বশুর দরিদ্র । বিবাহের কিছু দিন পরেই শ্বশুর আমাকে লইতে লোক পাঠাইয়াছিলেন, কিন্তু পিতা পাঠাইলেন না। বলিলেন, “বিহাইকে বলিও, যে, আগে আমার জামাত উপার্জন করিতে শিখুক—তার পর বধু লইয়া যাইবেন—এখন আমার মেয়ে লইয়া গিয়া খাওয়াইবেন কি ?” শুনিয়া আমার স্বামীর মনে বড় ঘৃণা জন্মিল—র্তাহার বয়স তখন ২০ বৎসর, তিনি প্রতিজ্ঞ করিলেন, যে স্বয়ং অর্থোপার্জন করিয়া পরিবারপ্রতিপালন করিবেন। এই ভাবিয়া তিনি পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রা করিলেন। তখন রেইল হয় নাই—পশ্চিমের পথ অতি দুর্গম ছিল। তিনি পদব্রজে, বিনা অর্থে, বিনা সহায়ে, সেই পথ অতিবাহিত করিয়া, পঞ্চাবে গিয়া উপস্থিত হইলেন । যে ইহা পারে, সে অর্থোপার্জন করিতেও পারে। স্বামী অর্থে পার্জন করিতে লাগিলেন-বাড়ীতে টাকা পাঠাইতে লাগিলেন—কিন্তু সাত আট বৎসর বাড়ী আসিলেন না, বা আমার কোন সম্বাদ লইলেন না। যে সময়ে আমার ইতিহাস আরম্ভ করিতেছি, তাহার কিছু পূর্বে তিনি বাড়ী আসিলেন । রব উঠিল যে, তিনি কমিসেরিয়েটের ( কমিসেরিয়েটু বটে ত ?) কর্ম্ম করিয়া অতুল ঐশ্বর্ষ্যের অধিপতি হইয়া আসিয়াছেন। আমার শ্বশুর আমার পিতাকে লিখিয়া পাঠাইলেন, “আপনার আশীর্ব্বাদে উপেক্স ( আমার স্বামীর নাম উপেন্দ্র-নাম ধরিলাম, প্রাচীনারা মার্জনা করিবেন ; হাল আইনে তাহাকে আমার উপেন্দ্র বলিয়া ডাকাই সম্ভব )—বধুমাতাকে প্রতিপালন করিতে সক্ষম। পাষ্ট্ৰী বেহারা পাঠাইলাম, বধূমাতাকে এ বাটতে পাঠাইয়া দিবেন। নচেৎ আঙ্গা করিলে পুত্রের বিবাহের আবার সম্বন্ধ করিব।” পিতা দেখিলেন, নূতন বড়মাকুব বটে। পাষ্ট্ৰী-খানার ভিতরে কিংখাপ মোড়, উপরে রুপার বিট, বাটে রুপার হাঙ্গরের মুখ। দাসী মাগী যে আসিয়াছিল, সে গরদ পরিয়া আসিয়াছে, গলায় বড় মোটা সোনার দানা । চারিজন কালো দাড়িওয়াল ভোজপুরে পান্ধীর সঙ্গে আসিয়াছিল। আমার পিতা হরমোহন দত্ত বুনিয়াদি বড়মানুষ। হাসিয়া বলিলেন, “ম, ইন্দিরে । আর তোমাকে রাখিতে পারি না। এখন যাও, জাবার শীঘ্র লইয়া আসিৰ। দেখ, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হাসিও না।” -
পাতা:ইন্দিরা-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৮৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।