পাঠভেদ ఫిగిరి পর একদিন অকস্মাং এ অন্ধকার পথে প্রদীপের আলো পড়িল, মনে হইল। শ্রাবণের রাত্রে নক্ষত্র দেখিলাম, মনে হইল । - এই সময়ে রাম রাম দত্ত আমাকে এক দিন ডাকিয়া বলিলেন, “আজ একটি বিশিষ্ট লোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছি—তিনি আমার মহাজন, আমি খাদক,-আজিকার পাক শাক যেন পরিপাট হয়। নহিলে বড় প্রমাদ হইবে।” আমি যত্ন করিয়া পাক করিলাম। আহারের স্থান অন্তঃপুরেই হইল-মুতরাং আমিই পরিবেশন করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কেবল নিমন্ত্রিত ব্যক্তি এবং রাম রাম বাবু আহারে বসিলেন। আমি অগ্রে অল্পব্যঞ্জন দিয়া আসিলাম—পরে তাহারা আসিলেন । তাহার পর মাংস দিতে গেলাম। আমি অবগুণ্ঠনবতী, কিন্তু ঘোমটায় স্ত্রীলোকের স্বভাব ঢাকা পড়ে না । ঘোমটার ভিতর হইতে একবার নিমন্ত্রিত বাবুটকে দেখিয়া লইলাম। দেখিলাম, তাহার বয়স ত্রিশবৎসর বোধ হয় ; তিনি গৌরবর্ণ এবং অত্যন্ত স্বপুরুষ ; তাহাকে দেখিয়াই রমণী মনোহর বলিয়া বোধ হইল। বলিতে কি, আমি মাংসের পাত্র লইয়া একটু দাড়াইয়া রহিলাম, আর একবার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। আমি ঘোমটার ভিতর হইতে র্তাহাকে খর দৃষ্টিতে দেখিতে ছিলাম, এমত সময়ে তিনি মুখ তুলিলেন—দেখিতে পাইলেন যে আমি ঘোমটার ভিতর হইতে র্তাহার প্রতি তীব্র দৃষ্টিতে চাহিয়া আছি। পুরুষে বলিয়া থাকেন, যে অন্ধকারে প্রদীপের মত অবগুণ্ঠন মধ্যে রমণীর কটাক্ষ অধিকতর তীব্র দেখায়। বোধ হয়, ইনিও সেইরূপ দেখিয়া থাকিবেন । তিনি একটু মাত্র মুছ হাসিয়া, মুখ নত করিলেন। সে হাসি কেবল আমিই দেখিতে পাইলাম। আমি সমুদায় মাংস তাহার পাতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া আসিলাম । আমি একটু লজ্জিতা, একটু স্বর্থী হইয়া আসিলাম। লজ্জার মাথা খেয়ে বলিতে হইল—আমি নিতান্ত একটুকু স্থখী হইয়া আসিলাম না। আমার নারী জন্মে প্রথম এই হাসি—আর কখন কেহ আমাকে দেখিয়া মধুর হাসি হাসে নাই। আর সকলের হাসি বিষ লাগিয়াছিল। এতক্ষণ বোধ হয়, পতিব্রতা মণ্ডলী আমার উপর ভ্রভঙ্গী করিতেছেন এবং বলিতেছেন, “পাপিষ্ঠে, এ যে অনুরাগ।” আমি স্বীকার করিতেছি, এ অনুরাগ। কিন্তু আমি সধবা হইয়াও জন্মবিধবা। বিবাহের সময়ে একবার মাত্র স্বামিসমর্শন হইয়াছিল—স্বতরাং যৌবনের প্রবৃত্তি সকল অপরিতৃপ্ত ছিল । এমন গভীর জলে ক্ষেপণী নিক্ষেপেই যে তরঙ্গ উঠবে, তাহাতে বিচিত্র কি ? আমি স্বীকার করিতেছি যে এ কথা বলিয়া আমি দোষ শূন্ত হইতে পারিতেছি না। সকারণে হউক, আর নিষ্কারণেই হউক, পাপ সকল অবস্থাতেই পাপ। পাপের নৈমিত্তিকতা নাই। কিন্তু আমার জন্মের মধ্যে এই প্রথম পাপ ও এই শেষ পাপ। পাকশালায় ফিরিয়া আসিয়া, আমার যেন মনে হইল, আমি ইহাকে পূর্ব্বে কোথাও দেখিয়াছি। সন্দেহ ভঞ্জনার্থ, আবার অন্তরাল হইতে ইহঁাকে দেখিতে গেলাম। বিশেষ করিয়া দেখিলাম। দেখিয়া মনে মনে বলিলাম, “চিনিয়াছি।”
পাতা:ইন্দিরা-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৯৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।