পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উনিশে মে : ভাষার সংকট ০ ১১৪ মনের কথাকে সঠিক সংকেতে গ্রহণ এবং যথাযথরূপে প্রেরণে সক্ষম বলেই তারা রূপদক্ষ কান্তিবিদ। কবির পরাবাস্তব সংকেত পাঠকের তরঙ্গ কক্ষে সঠিক ছিটকিনিতে কড়া নাড়ে, কথাকারের চেতনাপ্রবাহ সিম্‌সিম্ সংকেতকে কখনও ভুল করে না, নাটকে বিমূর্ততার ত্রিমাত্রিক অধিষ্ঠানও যোগাযোগে অসহজ হয় না, বা নন ফিকশনাল প্রোজে ক্রিটিসিজমের নবতম সংকেতগুলিও সাহিত্যবিচারে মাত্রান্তর ঘটিয়ে চলেছে অব্যাহত । সংকেতগুলিও সব সচেতন রচনা, নির্মাণ। শব্দ অক্ষরের চুনসুরকি ভিতে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃত জ্ঞানকে, ছয়তম স্থানে মানুষমনের ভাবে, এরা এইসব নির্মাণপটু কারিগরেরা বিভিন্ন অবয়বে নিয়ে আসেন। কেউ কবি, কেউ প্রাবন্ধিক, কেউ কথাকার । বাংলা ভাষায় কবিতে কথাকারে ভেদ ছিল না। কথাকে ছন্দে গাঁথা হতো মিলে, পয়ার ত্রিপদীর সীমাবদ্ধতা কবিতাকে শাসন করত। কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা, ভারতচন্দ্র রায় তাই কবি। বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, ত্রৈলোক্যনাথ কথাকে ছন্দের কৃত্রিমতা থেকে সরিয়ে আনলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবময় কাব্যিকতা গল্পগুচ্ছে কথা রচনার এক অনন্য ধারার সুচনা করল। হাসান আজিজুল হক সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গল্পকে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার বাইরে রেখেছেন। তার কথায় রবিকথা, প্রাত্যহিকতা খসিয়ে দিয়ে মানুষের ধারণাটাকেই ফুটিয়ে তুলেছে। জগদীশ গুপ্ত, প্রভাতকুমার কথাকে সমকালীন ইউরোপীয় গদ্যধারার পাশাপাশিতে নিয়ে গেলেন। তারপর অন্য পরিক্রমা, কল্লোল থেকে কিন্নর রায় । এই টানা-পোড়েন এখন শেষতম বৃত্তেই ক্রমাগত। বাংলা সাহিত্য এখন বৃত্তাত্তরে যাওয়ার প্রয়াসে নিরত। কথা দিয়ে চেতনার বিভিন্ন স্তরে ব্যতিক্রমী আলোড়ন তোলার প্রচেষ্টা চলছে বিশ্বময়। গদ্যে, কথাসাহিত্যের বিস্মৃততম মাধ্যম, উপন্যাস যান্ত্রিকতায় দুষ্ট। কেউ কেউ বলেন যান্ত্রিকতাই ক্লাসিক সাহিত্যের প্রধান উপাদান। বিরোধ নেই বিন্দুমাত্র নির্মাণই তো সৃষ্টির সার, তবে জীবনবিমুখ নির্মিত পণ্য কখনই সাহিত্য নয়। কথাসাহিত্যের ছোটো শরিক ছোটোগল্প এখনও সম্পূর্ণ জীবনমুখী রয়েছে। লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্প বাংলা ভাষায় এখন প্রেরণাস্থল না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না, হলো কই। মার্কেজ এখনো নামে মাত্র পরিচিত, অন্যরা তাও না। মানুষমনের কথা, মানুষের কথা জানতে হলে সেই সময়ের আন্তর্জাতিক মানুষমনকে জেনেই মানুষের ভাষা আয়ত্তে আনা। না হলে জীবনানন্দ যেমন বলেছেন : ‘মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া, বিশেষণ, এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।' দুই 'কে বলে এ আমার নয়? তোমার নয় কে বলে?