আমাদের প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক! নইলে সমস্যার কথা আমরা যা বলি, প্রধান ভুবন কলকাতার কথাকারও তো তাই বলেন। ভগীরথ মিশ্র বাংলাভাষার সব্যসাচী কথাকার, নাগরিক ভাষায় যেমন, রাঢ়গ্রামীণ, সাওতালী, শুদ্ধ বাংলায় সমান পটু। তাঁর গল্প শুধু পুরুলিয়া বা দখ্নো দেশে ঘোরে না। ভগীরথ মিশ্রর চোখ যেখানে যায় মাটির একাত্মতা না নিয়ে কলমে আঁচড় কাটে না। পশ্চিমবাংলার গল্পকারদের মধ্যে উজ্জ্বল ভগীরথ গল্পকার উপভাষা, নাগরিক ভাষায় সমান সিদ্ধ তবু তারও কথা-ভাবনায় প্রধান সমস্যা, উপভাষার প্রয়োগ। সাঁওতালিরা বাংলা বোঝে মোটামুটি, বাংলায় কথা বলে না কিন্তু সাঁওতাল চরিত্রে ‘যাবেক লাই’, ‘খাবেক লাই’, দিয়ে সংলাপ স্বভাবের একটা নমুনা তৈরি করে নিয়েছি। এও কি সঠিক! আবার ওদের নিজস্ব ভাষার সংলাপ ব্যবহার করলে বাংলা ছোটোগল্প দুর্বোধ্যতার দায়ে পড়বে কিনা, এ সংকট কথাকারের। কথোপকথনের ভঙ্গিতে বলা প্রশ্নের পাশাপাশি আমারও সমস্যা ছিল মণিপুরি, কাছাড়ি ভাষার চরিত্র নিয়ে, চা শ্রমিকের ভাষা নিয়ে, আমরাও তো তেমন আদর্শ সংলাপ স্বভাব তৈরি করে নিয়েছি চা শ্রমিকদের জন্য। বরাক উপত্যকার বহুপ্রজ গদ্যকার গণেশ দে-এর একটি গল্পের দুটি অংশ থেকে সাক্ষ্য নেওয়া যায়—
‘যেতে যেতে সর্দার পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে বলল—ই তুমি ঠিক বাত বইলছ বাবু সাব। হামরা মাটি কোপাই, ধারায় ভিজি, তাপে পুড়ি, জঙ্গল সাফ করি তবে না চাহের গাছ বাড়ে, পাত্তি হয়।’
বা
‘সিকমানিয়া এই বাগানেরই একটা মেয়ের নাম। এরা হাসপাতালকে বলে ‘সিকমান’। হাসপাতালেই অর্থাৎ সিকমানেই ও লালিত হয়েছিল বলেই হয়তো ওর নাম রয়ে গেছিল ‘সিকমানিয়া।’
যদিও ওর পিতৃপরিচয় জানা ছিল না তবু ও যে শ্রমিক মায়ের পেটে কোনো ফর্সা চামড়ার বাবু জাতীয় কাপুরুষের সন্তান, তা ওকে দেখলেই মনে হতো। সর্দারের ভাষায়-‘বাবুদের লেড়কির মতো ধলা, লরম, লরম...।’ (সিকমানিয়া)
বা আর একজন গদ্যকারেরও সাক্ষ্য নিতে পারি, বাংলা রচনা থেকে যিনি এখন বহুদূরে, কলকাতা স্টেট্সম্যান-এর সাহিত্য ক্রোড়পত্রে প্রায়ই যার বিশাল সব বুক রিভিউ, আলোচনা ছাপা হয়। একদার কথাকার নির্মলকান্তি ভট্টাচার্যর বিস্মৃত এক গল্পাংশে চা বাগানিয়া সংলাপ-এর আদর্শ ব্যবহার ছিল।
‘কীরে ঝিলুয়া, হরিয়া, কী আলাপ করছিলে এতক্ষণ?
বলতে বলতে মাসডরবাবু নাচঘরে এসে দাঁড়ালো।
হরিয়া বললে—বহুত জরুরি বাৎ-চিৎ মাসডর বাবু। বড়ো সাহেব আজ লছমিকে বাংলায় ডেকে নিয়ে খুব মারধর করেছে। টিলাবাবু উর বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল সাহেবের কাছে। লছমি নাকি গতকাল টিলাবাবুর ছোটো লেড়কির গলার হার চুরি