পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উনিশে মে: ভাষার সংকট □ ১২

 সে তো আর রবিঠাকুরের নোবেল নয়, এক সোনার চাকতি, যে ম্যাজিক করবে!

 স্মৃতি থেকে পলি সরিয়ে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যেতে হবে উত্তরাধিকারের মুখোমুখি। পঞ্চাশ বছর পর নবীনের অধিকার রয়েছে তথ্য জানার। তাই মাতৃদুগ্ধসম মাতৃভাষার গরিমা রক্ষায় একাদশ শহিদের কথা নতুন করে শোনানো হোক। বারবার জানানো হোক। পথে পথে, ঘরে ঘরে, পার্কে পার্কে গড়ে উঠুক নতুন নতুন শহিদবেদী, বড়ো বড়ো করে লেখা হোক শচীন, কমলার নাম। লেখা হোক হীতেশ, সত্যেন্দ্র, চণ্ডীচরণ, সুনীল, সুকোমল, তরণী, কানাইলাল, কুমুদ, বীরেন্দ্রর নাম। লেখা হোক বাচ্চু, যিশু-জগনের নাম। কিন্তু এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা। একশো পাঁচ বছর আগে এমন ছিল না।

 বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের পর থেকেই বিষময় ঝড়ের প্রতিকূলতা বইতে হয়েছে বাঙালিকে। বাঙালি জীবনে দুঃখের সেই শুরু। বাঙালি কেন যে হিন্দুও হইল, মুসলমানও হইল, শুধু বাঙালি হইল না।

 ও-পারে যারা ভঙ্গ বঙ্গ নিয়ে গেলেন তারাও কি সর্বসুখে আছেন, এপারের ভঙ্গ ভারতেও বাঙালিকেই শুধু ভাষার প্রশ্নে বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এক সম্মিলিত চক্রান্তের শিকার হয়ে ভাষা জননীর বেদী বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে। অখণ্ড থাকলে এমন হত না।

 ও-পারে শুরু হয়েছিল ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে, এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষের উৎপাটন হয়েছিল। ভাষাশহিদের রক্তে ধুয়েমুছে গিয়েছিল মহম্মদ আলির আস্ফালন—উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের ভাষা। বাঙালির ভাষা। এ-পারেও ভাষাবেদী অপবিত্র করার আর এক চক্রান্ত শুরু হয়েছিল গোপীনাথ বরদলৈর উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাগাড়ম্বরে, আসাম শুধু অসমিয়া ভাষীর। জাতির পিতা দূর থেকে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ভারত তবে কার। এ যেন দ্যূতসভায় দৌপদ্রীর বস্ত্রহরণ দেখে পিতামহর স্বগতোক্তি, ধর্মের গতি সূক্ষ্ম।

 একুশে করে দেখিয়েছে উর্দু নয়, পাকিস্তান নয়, বাঙালির নিজস্ব ভুবনের নাম এখন ‘বাংলা’ ‘বাংলাদেশ’। একুশের আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গরিমা। শিখিয়েছে পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতেই যা টিকে থাকবে দৃঢ়ভাবে। একুশ তাই বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস এখন। বাঙালি না হলে মাতৃভাষার অমৃতভাণ্ডারের কথা জগতে জানাত কে। আর এ-পারে স্বাধীন ভারতবর্ষেও খণ্ড ছিন্ন বাংলা ভুবনের সংখ্যা কম নয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়া অসম প্রদেশেও বাংলা ভাষীর সংখ্যা বিপুল। স্বাধীনতার শর্তে বাঙালিকে বারবার পঙ্গু করার শপথ যে নিয়েছিলেন দেশনেতারা। হয়তো নেতারাও তখন ছিলেন অসহায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিকতা ছিল না, মনে ছিল অনেক সমীকরণের অঙ্ক। তাই, সাহেবদের কথায় দেশভাগের লাইন কেটেছেন, গণভোটের প্রহসন করেছেন। হয়তো সময়ের চাহিদা ওরকমই ছিল নেতাহীন বাঙালির