পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ১৩

ভাগ্যে। তাই পূর্বপুরুষের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ছিন্ন মূলমন্ত্রকে প্রবোধ দেয় উত্তরপুরুষ। সরল সমাধানে শান্তি খোঁজে।

 সমাধান এত সরল ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অতলে যাওয়া বাঙালি দেশ নেতার অগম্য ছিল। এমনকি অসমিয়া বা দিল্লিবাসী নায়কদেরও। তাই দোষ কারো নয় বলে অদৃষ্টের পরিহাস ধরে নিয়ে, কালস্রোতে নির্বাসিতা বরাকভূমিকে বাঙালির এক মাতৃভুবন হিসেবে গড়ে তোলার শপথ এই প্রান্তিক বাঙালিকেই নিতে হচ্ছে।

 অদৃষ্ট যে নয়, নইলে কেন, সিলেট জেলার একটি মহকুমা আর সাবেক কাছাড় জেলা নিয়ে একদা সংখ্যা গরিষ্ঠজনেরা নতুন সমীকরণে সংখ্যালঘু ভূখণ্ডের আবাসিক থেকে গেলেন আসাম প্রদেশের উপনিবেশ হয়ে।

 সংখ্যালঘুদের পদানত করার কথা গণতন্ত্রের সনদে না থাকলেও, বাস্তবের চাতুর্যে ঘটে। বাংলাভাষী ভূখণ্ডকে অসমিয়াকরণের প্রক্রিয়া চলছে। ভাষা বিল যেমন গৃহীত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে প্রায় দুই শতাধিক অন-অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে। তাই বরাক উপত্যকার আপামর মানুষ গর্জে উঠে জানিয়েছিল, জান দেব জবান দেব না।

 উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার পরীক্ষা ম্যাট্রিক শেষ হয়েছে আঠারোই মে। উনিশ তারিখ ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বেচ্ছাসেবকের দল সরকারি অফিস-কাছারি, রেলস্টেশনে জমায়েত হয়েছে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য। মুখের ভাষায় কথা বলা, পড়াশুনা, সরকারি কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে।

 নবীন গণতন্ত্রে তখন কিন্তু সুখেই ছিল দ্বিশতাধিক ভাষাগোষ্ঠীর জনপদ। কেউ একনায়ক হতে চাইল বলে, একভাষিক হতে চাইল বলে আসাম শুধু অসমিয়াভাষীর বলে আস্ফালন করল বলে বরাক উপত্যকার মানুষ একজোট হয়ে সংগ্রামে সামিল হল। বরাক উপত্যকার বদরপুর থেকে নির্বাচিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা নির্বাচন ক্ষেত্রকে উপেক্ষা করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বরাক উপত্যকার বিধায়কদের আপত্তি উপেক্ষা করে ভাষা বিল পাশ করিয়ে নিলেন।

 আলাপ-আলোচনায় যখন কাজ হল না, তখন অহিংস সংগ্রামকে হাতিয়ার করলেন বরাকবাসী এবং পরিকল্পিতভাবেই বিনা প্ররোচনায় রহস্যজনকভাবে একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। উনিশে মে-র দ্বিপ্রহরে সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। গুলিবর্ষণে এগারোটি তাজা প্রাণ চলে যায়। অসংখ্য আহতও হন।

 কুম্ভীরাশ্রু নিয়ে আসা আসামের মন্ত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় সদরঘাটের ও-পার থেকে। এলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। শাস্ত্রী ফর্মুলা মেনে ছেলে-ভুলানো মোয়া দেখিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। মানুষ মানল না, বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা স্বীকৃত হল।

 কিন্তু সংখ্যাগুরু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ভাষা আগ্রাসন চলছে এখনও। পাঠ্যপুস্তকে, বিজ্ঞাপনে অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া চলছে।