পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ২০

রোপিত বীজের বিষবৃক্ষ দেশ আলাদা করে দিল ধর্মীয় বাঙালির। পশ্চিমা প্রলোভনে নেতৃত্বহীন বাঙালিকে মেনে নিতে হল বিদেশি ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভাষাবিদ ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তাঁর বিখ্যাত উক্তি—'আমরা হিন্দু এবং মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি'। হয়তো এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই শুরু হয়েছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মদেশে। যার ফলশ্রুতিতে হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মদেশ-এর বন্ধন ছিঁড়ে ভাষাদেশ হয় বাংলা। কাঁটাতারের বেড়ার কাঁটা দুই বাঙালিকে জখম করে কালক্রমে। ওপার বাংলায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাষার বিবর্তন হয়। ভাষা তো সামাজিক মত বিনিময়ের মাধ্যম। তাই ওপারে যখন আরব দেশের ধর্মমানুষ বাঙালি নব্বই শতাংশ তখন ধর্মীয় ভাষাই জীবনকে জড়িয়ে নেয়। এখন ওপারের বাঙালি নাস্তা করে গোসল করে দাওয়াত দেয় সুক্রিয়া বলে। ওপারে ধুতি পরা বারণ। পায়জামা যে জাতীয় পরিধান, এপারেও কি কেউ আর ধুতি পরে, পূজোর সময় পুরোহিত প্ল্যাস্টিকের ক্যারিব্যাগ এ নিয়ে যায়, পুজো শেষে আবার ক্যারি সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে। এখন কেন্দ্রে রাজ্যে ধর্মীয় সরকারের প্ররোচনায় হয়তো নতুন বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হবে, আবার ভাঙন, ব্রেক্সিটের পর এখন তো সবাই গণভোটের জিগির তুলতেই পারে। গণতন্ত্র মানেই কি শুধু ভাঙন তবে। তা কেন, তাহলে তো কবেই পৃথক বরাক উপত্যকা রাজ্য হয়ে যায়।

 নীহাররঞ্জন লেখেননি বলে যে বাঙালির ইতিহাস মধ্যপর্ব ধারণ করেনি তাও তো নয়। বিবর্তনের প্রক্রিয়া ছিল বলেই বাঙালি এখন এই পর্যায়ে, ঈশ্বরচন্দ্রের বাংলা বঙ্কিমের বাংলা মধুসুদনের বাংলা মীর মশারফের বাংলা কায়কোবাদ এর বাংলা থেকে আলালের বাংলা হাসন রাজার বাংলা থেকে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' এর শাহ আব্দুল করিমের বাংলা তো বিবর্তনেরই ফসল। এর মধ্যে কিছু বিভ্রান্ত বাংলাও আছে। যেমন সিলেটি বাঙালির একাংশ বলছে তারা আলাদা জাতি, কারণ তাদের নিজস্ব লিপি আছে, সিলেটি নাগরি। সাতশ বছর আগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত ব্রাহ্মীলিপিতে ধর্মীয় সাহিত্য রচনায় অস্বীকৃত হওয়ায় আরবি ফারসি ও সিলেটি বাংলার মিশ্রণে এক বিভাজনের লিপি এবং সাধনার লিপির সৃষ্টি করেন ধর্মীয় পদকর্তাদের পদরচনার মাধ্যমে। এর মধ্যে কয়েকজন মাত্র অসাধারণ সাহিত্য গুণান্বিত গীতরচনা করেছেন সিলেটিতে। বেশির ভাগই সিলেটি বাংলা থেকে আরবি ফার্সির প্রাধান্য। ধর্মজ্ঞানী ছাড়া বাকি বাঙালির কাছে দুর্বোধ্য। আত্মনির্মাণের ভিত্তিভূমি কেউ তৈরি করে রাখলেন না মধ্যপর্বের তাই আমরা যে যেমন পারছি, ইতিহাস বানাচ্ছি, মজার ব্যাপার খোদ সিলেটে নাগরি লিপি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই, বিলেত আমেরিকায় হচ্ছে। আসলে সামাজিক ইতিহাসের শূন্যস্থানে এক মাৎস্যন্যায় চলছে, বহুজনের মানে সংখ্যাগুরুর ন্যায়ে গড়ে উঠেছে ইতিহাস, সত্য গেছে নির্বাসনে।