পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৩৪

নেই ভাষাসৈনিকের। মাতৃভাষা নিয়ে মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করলে বলা হয় আঞ্চলিকতা, একুশে ফেব্রুয়ারি হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। বরাক উপত্যকার বাঙালি বড় নিরপেক্ষ, যুক্তি দিয়ে নিজেকে শাসন করে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমিয়া বুদ্ধিজীবীর দল একযোগে খুলে ফেলেছেন মুখোশ, যুক্তিবুদ্ধির প্রগতিশীল একজন হীরেন গোঁহাইও তাই। আমাদের ‘আঞ্চলিক' অভিধানে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিটাইহয়তো নেই, আছেন কিছু স্বার্থান্ধ রাজনীতির কারবারি, যারা ভোটের বাক্সে তাকিয়ে থাকে শকুন চোখে, বক্তৃতার জ্বালায় তাতিয়ে দেয় ভোটারকে তারপর একমাস দ্বৈপায়ন হ্রদের ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে জনতার তাপ উপশম করে। এরা চোরকে বলে চুরি কর গৃহস্থকেও আধো ঘুমে থাকতে বলে। এরা রাবড়ি বানায়, কড়া আঁচের দুধে পাখার বাতাস দেয়। এরা চেমা-ইমানদার। ইমানদার কথাটা কথার কথা, ইমানের লেশমাত্র নেই। নইলে আঞ্চলিক আন্দোলন অভিধার দুর্নাম ঘুচিয়ে কী ভাষা আন্দোলনের ছেচল্লিশ বছর পরও একটা রেলওয়ে স্টেশনের নাম বদল করতে পারে না মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক। আমরাও ভোট দিয়ে জিতিয়ে যাচ্ছি, একই মুখ, মুখের সন্তান। তাদেরও দুএকজন ছাড়া সবার মাতৃভাষা বাংলা, যে ভাষায় দুই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রগীত গাওয়া হয়। যে রাষ্ট্রগানের স্রষ্টাও সেই মহামহিম, বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আর কী কেউ আছেন এমন দুর্লভ সম্মানের ভাগীদার এই পোড়া মহাদেশে সেই কবির মুখের ভাষায় কথা বলার, পড়াশুনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে শুরু হয়েছে এক অগণতান্ত্রিক ছেলেখেলা। বাঙালি স্বাধীনতাচেয়েছিল, সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগও করেছে বাঙালি। স্বাধীনতা পেয়েছে বড় কষ্ট সয়ে, বুকের ভিতর হৃদয়টাকে দুভাগ করে।

এপার উত্তরপূর্বে সিলেট বিদায় হয়েছিল বাঙালি-বিদ্বেষের পরাকাষ্ঠা হিসেবে তৎকালীন গোয়ালপাড়া জেলা সম্পূর্ণ এবং নওগাঁ জেলার দক্ষিণ ভাগ তো বাঙালি ভূমিই ছিল। কত ছলনার আশ্রয়ে বাঙালিকে আত্মরক্ষায় বাধ্য করা হয়েছে, এসব স্থানে বাঙালি হয়তো উচ্ছেদ হয় নি কিন্তু এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে,মাঝেমাঝেই গোরেশ্বর নেলির ভয় দেখানো হয়। যাতে ত্রাসের প্রথম দর্শনে সবাই আসাম ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যাবে বাঙালি নিজবাসভূমি ছেড়ে। বরাক উপত্যকার তিন জেলাকেও বাঙালি শূন্য করার অলীক আনন্দে মেতেছে দেশমুখ্য থেকে, আশায় বাঁচা চাষা লেতিপেতি নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত। অসমিয়া ভোটাররাও কী করে এতো সহজে ভুলে যাচ্ছেন নবীন দুলাল ভৃগু সমুজ্জ্বলদের চাতুর্য বাক্যে। কোথায় যাবে যদি নাগরিক পঞ্জি বাঙালিকে আসামের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশ নেবে, পশ্চিমবঙ্গ নেবে, নেবে দণ্ডকারণ্য। দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার নামই আসাম রাজনীতি যেখানে জনগণের কল্যাণ হল আবেগের সুড়সুড়ি। ক্ষুধার অন্ন নয়, নাগরিক জীবনের মানোন্নয়ন নয়, একমাত্র লক্ষ্য বিদ্বেষ। ওদিকে বরাক উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির মেরুদণ্ডে চিড় ধরিয়ে নয়া অসমিয়া তৈরি করা হয়েছিল একসময় এখন সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।