পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৩৫

অধুনা চরনিবাসী বাঙালিদের কিংবা নতুন অসমিয়াদের নিধন যজ্ঞেও কিন্তু অসমিয়া নেতৃত্ব নিশ্চুপ। এখন নতুন এক বুদ্ধিজীবী বাঙালি সমাজের উদ্ভব হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। হাঁসজারু বললে আঁতে ঘা দেওয়া হয়, কিন্তু সত্যিই তো তারা আত্মসমর্পণ করেন নি অসমিয়া ভাষিক আগ্রাসনের কাছে। সাময়িক সমঝোতায় বিহু সত্রিয়ায় মজে আছেন হয়তো সঠিক সময়ে ফুটে বেরোনোর জন্য। তবে পরিতাপেরও কিছু ব্যাপার আছে, অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বরাকের বাঙালির মুণ্ডচ্ছেদ করে থাকেন কেন। আসাম আন্দোলনের সময় বাধ্যতামূলকভাবে বাঙালিকে আন্দোলনে মিছিলে স্লোগান দিতে হয়েছে, খেদিবই লাগিব। মানে তাড়াতেই হবে বাঙালি বোকার মতো স্লোগান সাজিয়েছিল সেদিন 'বুঝলাম তো যাইতাম কই”।

 স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ছিল বেঁচে থাকার লড়াই। তৎকালীন করিমগঞ্জ মহকুমা থেকে শুরু হয়েছিল আন্দোলন, করিমগঞ্জ মহকুমায় তখন নেতার মতো নেতা ছিলেন ভরবয়সী, আন্দোলন হাইলাকান্দিও পৌঁছে যায়, শিলচরে কোন্দল ছিল কিন্তু স্বাভাবিক নেতৃত্বের ভূমি কী করে বঞ্চিত হয়। যৌথ নেতৃত্বের দাপট দেখেছে তখন বরাকভূমি। কথায় কথায় ওরা গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। বিধানসভায় দলের বিরুদ্ধে গিয়ে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছেন। বাঙালি তখন ভাষার প্রশ্নে এক হতে পেরেছিল তাই হয়েছিল অভূতপূর্ব ভাষা আন্দোলন। উনিশ শ একষট্টির উনিশে মে থেকে যার শুরু। শুরু হয়ে এক বছরেই থিতু হয়ে গেল মেহরোত্রা কমিশন বাক্সবন্দী হওয়ার পর। এনসি চ্যাটার্জি কমিশনের আবেগ থাকতে থাকতে। অগ্নিমূর্তি নেতারা সব হয়তো রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলেন দলবদল থেকে আরম্ভ করে পদের লোভে অনেকে অনেক কীর্তিকাহিনি করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা হল। তবু বাঙালির রক্ত বীজে বাঙালিত্ব বহমান বলে আন্দোলন থেমে থাকে নি। দফায় দফায় আরও চারজন শহিদ হলেন ভাষা সংগ্রামে। দু'বছর আগেও আবার এক বিতর্কিত সার্কুলার জারি করেও উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকদল। যদিও অন্য উপায়ে বরাক উপত্যকার বাঙালির প্রতি বৈষম্য বজায় রেখেছে সংখ্যাগুরু শাসক। বরাক উপত্যকাকে ভাতে মারার চেষ্টা হয়েছে ব্রডগেজ আর মহাসড়ক প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে। ধর্মে মারারও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এসব তো পুরনো চাল দিয়ে ভাত বাড়ানোর খেলা। বরাকের বাঙালি ধর্মের বিভাজন আর মানে না। তাহলে কোথায় থাকল জট। বরাকের বাঙালি তো শান্তিতে থাকতে চায়। কারো হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চায় না, তাই পৃথক রাজ্যের দাবিও প্রত্যাখ্যান করে। তবু কেন পাঠ্যপুস্তকে অসমীয়া ভাষার অনুপ্রবেশ, হোর্ডিংয়ে সাইনবোর্ডে আগ্রাসন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে গামোছা সংস্কৃতি। কে কবে কোথায় কোন বাঙালি গামোছা ব্যবহার করেছে প্রীতির বিনিময়ে। রাজনীতিতেও জনগণের স্বার্থে মাতৃভাষার স্বার্থ কোনো ঐক্য নেই। এখন শুধু সুদিনের স্লোগান। বিবেকের দায় নেই। এখন রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। আর ক্ষমতা হাতে থাকলেই মানুষের পরিচয় বেরিয়ে পড়ে। আব্রাহাম লিঙ্কন এরকম কথা বলেছিলেন। তাই এখন শুধু ভোটারকে বিভক্ত করে সূচিত করা হচ্ছে জাতি উপজাতি ধর্মে।