পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৩৮

না, কিন্তু জবাব মেলেনি একজাতি কেন দুই হল, কেন দেশভাগ হল। নানাজনের নানা মত যে।

 মতের তর্কে এতদূর যাওয়ার ধৈর্য বাঙালির নেই। আমার সাধারণী মায়ের কথা জানি, তিনি কোনো বিখ্যাত মানুষ ছিলেন না, তাই তাঁর কোনো দায়ও ছিল না বাঁধা বুলির রাজনৈতিক শুদ্ধ কথা বলার। অসাম্প্রদায়িক কিংবা নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য কোনো কেতাব পুঁথির পাঠ তেলাওয়াত শিখতে হয়নি তাঁকে। তাঁকে কেউ বিদ্রোহিনী বলে সম্মান বা বিদ্রূপও করেনি কোনোদিন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মে আলাদা হলেও বাঙালি এক জাতি। তিনি তাঁর ধর্মগোষ্ঠীর অন্ধতাকে অমান্য করার মতো সাহসিনীও ছিলেন না। দাদার বিয়েতে এক স্ত্রী আচার অনুষ্ঠান 'পানখিলি'তে মজিদদার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেন মা। এই অনুষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ প্রায় নেই বললেই চলে, কোনো ঠাকুর দেবতা নেই মন্ত্রপাঠ নেই কয়েকজন এয়োস্ত্রী বসে বসে পানের খিলি বানাবে, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি গুঁজে দেবে চুন খয়ের ছাড়া সাজা খিলিপানের গায়ে। জাহানারা বউদি পাড়ার মহিলামহলে খুব প্রিয় জানতাম, উপস্থিত এয়োতিদের সঙ্গেও তো খুব ভাব। কিন্তু দেখা গেল একসঙ্গে বসে খিলি বানানোয় উশখুশ। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, পান তাম্বুল দিয়ে দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানোর অনুষ্ঠান করতে হয় শুদ্ধাচারে, যার অর্থ দেবতা যেখানে সেখানে কেন ভিনধর্মী। আমার স্পষ্টভাষী মা কোনো নাটক করেননি, রাগারাগিও না, জাহানারা বউদিকে কাছে ডেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।

 আমার দিদিমার ছিল ছোঁয়াছুঁতের বাতিক, মানে কুসংস্কার। শৈশবের এক শীতের রাতের কথা মনে পড়লে এখনও আতঙ্কিত হই। প্রতিবেশি এক নিঃসন্তান দম্পতির বাড়িতে খিচুড়ি খেয়েছিলাম রাতের বেলা, অপরাধ এত গুরুতর বুঝিনি, কনকনে ঠাণ্ডাজলে চান করার পর বুঝলাম আমি শুদ্রজাতির হলেও কৌলিন্যের একটা ব্যাপার আছে যা ছুতোর মিস্ত্রি থেকে কয়েক ধাপ উপরে। আমার মা সে রাতে তাঁর মাকে বাধা দেননি আমাকেও কোনো স্তোকবাক্যে আদর করেননি, কয়েক বছর পর, বুঝদার হওয়ার পর বিজয়া দশমীর দিন বিশুকাকু আর কাকিমাকে প্রণাম করে আসতে বলেন।

 এসব ব্যাপার যে মুসলমান সমাজে আছে জানা ছিল না, বাংলাদেশ ঢাকার এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় আমার মাকে প্রগতিশীল বোঝাতে গিয়ে ওসব গল্প বলেছিলাম। সেই বন্ধুটিও সঙ্গে সঙ্গে শোনালেন এক অজানা তথ্য। বললেন তাঁদের বাড়িতেও এরকম ছ্যুত অচ্ছ্যুত অজাত কুজাত অশুচির অন্ধ সংস্কার বর্তমান ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। তাদের নড়াইল বাড়িতে হিন্দুদের আনাগোনো খানাপিনা ছিল সবসময়। আতিথেয়তার কমতি থাকত না, তবে যেটা কেউ জানত না সে হল হিন্দুর এঁটো ধোয়া মাজার পর গৃহকর্ত্রীকে চান করে শুচি হতে হত। এসব ছিল, ঢাকার বাড়িতে নেই, না হলে আমরা গিয়ে থাকি কী করে ভূতের গলিতে। এসব গল্পের যে একটি ইতিবাচক দিক আছে সে সত্যিও জানাতে ভুলেন নি বন্ধুটি যে নানির চান করে শুচি হওয়ার