পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৩৯

কুপ্রথায় অতিথির প্রতি অসম্মানের কোনো ব্যাপারই ছিল না, ধর্মের অন্ধ বাধ্যবাধকতাই ছিল প্রধান। সামাজিক কুপ্রথাই যে ক্রমান্বয়ে ধর্মের নামে জমা হয়, দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। ঘর ভাগ হওয়ার প্ররোচনা দেয়। মুসলমানরা গোরুর মাংস খায় বলে বাঙালিরা চিচিঙ্গে নামের সুন্দর সবজি খায় না গোরুর শিঙ্গের মতো দেখতে বলে, বাচা মাছের মতো রুপোলি লাড়িয়া মাছটিও মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ, যেমন পাঁঠা ছাড়া বাকি সব চারপেয়ে হিন্দুর অভক্ষ্য, দুপেয়ে হাঁস চলতে পারে মুরগি অচল। হাঁসের ডিমে বারণ নেই মুরগির ডিম নৈব নৈব চ।

 তখন বেশ বড়ো হয়েছি কলেজে পড়ি, চৌদ্দ বছর বয়স, হাফপ্যাণ্ট থেকে ফুলপ্যাণ্ট পরার প্রমোশন একদিকে, খালি পা থেকে সদ্য বেরোনো হাওয়াই চটি পরার আনন্দ, দু'একটা সিগারেট খাওয়ার লুকোচুরি আর ছেলেদেরে স্কুল থেকে কো-এডুকেশন কলেজে পড়ার উত্তেজনায় দুম করে টাইফয়েড বাঁধিয়ে বসি। ডাক্তার ঔষধপত্র লিখে দিলেন, বলবর্ধক পথ্যাদি দিয়ে বললেন রোজ একটি করে মুরগির ডিম খাওয়াতে হবে হাফবয়েল। এবারও আমার ধর্মমতি দিদিমা হিন্দুমতে তওবা করলেন, তবে নাতির নিরাময়ের স্বার্থে ভেঙে ফেললেন বেড়া প্রাচীর, পাশের মেসবাড়ির রাঁধুনি সাধুর সঙ্গে রফা করলেন অর্ধ সিদ্ধ অগুভক্ষনের এক অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সাধু ডিম ছাড়িয়ে নুন মেখে চামচের ডগায় করে খাওয়াবে, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খপাৎ করব, এইটুকুই আমার পরিশ্রম। শরীর পেট বাইরে থাকুক মুখটিতো বাইরে রইল। শ্যাম কুল দুইই রক্ষা হল। এসব অনেক বাধা নিষেধ প্রতিবন্ধকতা ছিল সেকালে।

 দেশভাগের বিপর্যয় সময়ে আমার কট্টরপন্থি দিদিমা ছিলেন একা সহায়হীনা মহিলা, কিছু টাকা পয়সা কুড়িয়ে বাড়িয়ে এদেশের কাছাড় জেলায় চলে এলেন, সঙ্গে অবিবাহিত ছোটোমাসি আর সদ্যযুবক দুই মামাকে নিয়ে। ভুলু মামা যে আমার আপন মামা নয় বাড়ির কাজের মানুষ মাত্র সে বুঝিনি কোনোদিন, এমনকি আমার শুদ্ধাচারী দিদিমা যখন তাকে কলাইকরা থালায় খেতে দিতেন রান্নাঘরের ভিতর থেকে বাইরে তখনও বুঝিনি দিদিমার ছোঁয়া বাঁচানো ব্যঞ্জন পরিবেশনে। মাকে দিদি আর মাসিকে ভুলু ডাকেও ভাইবোনের সম্পর্ক জেনেছি, আমরা আদরের ভাগ্নেদেরও যে মাথায় উঠিয়ে নিয়ে যেতেন বরাকের নদীস্নানে। শুধু একটাই খটকা ছিল, ভুলুমামার নাম আর ছোটোমাসির নামও ভুলু হয় কী করে। ভুলুমামা আমাদের অনেকটা বড় করে একদিন চলেও যান কোথায়, পরে শুনেছি পাকিস্তানের সিলেটে তাঁর বাড়ি, তিনি ভুলু মিয়া।

 হাইলাকান্দি শহরে আমার মায়ের দাদুর বাড়ি, প্রায়ই যাওয়া হয় ওখানে, কত কত আত্মীয়, মামা আর মাসির বাড়ি এখানে ওখানে। খোকামামা দারোগার বাড়ি স্টেশনের উল্টোদিকে, আমার পছন্দ দুই মামাতো ভাই গোপাল বলাই, তাই ওখানেই যাওয়া। বিকেলে দেখতাম মামার বাড়িতে চাঁদেরহাট বসে যেত। বিশাল বারন্দায় বসত মামাদের আড্ডা, সঙ্গে চা ও তামাক খাওয়া। ললিত মামা আনোয়ার মামা মকবুল মামা আরও