পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪১

বিদ্বেষী জয়শ্রীরাম আর একদল হয়েছে কম্যুনিস্ট। এরকম হয় না, কিছু জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, বাঙালির যুক্তিবাদী ধারাটি প্রবল বলেই মুক্তমনারাই সংখ্যাগরিষ্ট। দেশভাগের পর প্রথম নির্বাচনের সময় খুব ছোটো ছিলাম, শিক্ষক বাবার বুকপকেটে কাস্তে ধানের শিষ আঁকা একটি প্রতীক আবিষ্কারের আনন্দ স্নান করে জুটেছিল গালে চটাস এক থাপ্পড়। পরে বুঝেছিলাম কম্যুনিস্ট হওয়ার ছিল অনেক বিপদ। কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ না হলেও ওটা প্রকাশ্যে দেখানো ছিল বারণ। দেশভাগ হলেও ধর্মহীন বর্ণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা তখন যেমন ছিলেন এখনও আছেন সংখ্যালঘু হয়ে। বাবা নেই, মা বেঁচে আছেন একশ ছুঁই ছুঁই। মাকে এখন সব কথা বলা যায় না তাঁর বধিরতার জন্য। ভালোই হয়েছে এখনও যে বাঙালির এক হওয়ার কথা বলতে পারছি না বড়োমুখ করে।

 বাঙালির জন্য দেশভাগ কতোটা অপরিহার্য ছিল সে সত্য ওপারে একরকম এপারে অন্যরকম। হয়তো তখন উচ্চবর্ণের ভূস্বামীদের অন্ত্যবর্ণ ও গরীব মুসলমানদের উপর অত্যাচার এবং অবিচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে। হয়তো জাতি হিসেবে বাঙালির কোনো অভিভাবক ছিলেন না মোক্ষম সময়ে। অনেক রকম বিকল্পও তো ছিল, বাংলা কিংবা বঙ্গ নামে বাঙালির আলাদা দেশ হতে পারত। উড়ে এসে জুড়ে বসতেন না তের নদীর পার থেকে কোন মহাম্মদ আলি জিন্না। দেশের নেতাও ভারত বাঁচাতে বলেছিলেন দেশভাগ প্রস্তাব তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে গৃহীত হবে, বিকল্প হিসেবে তিনি জিন্নাকেও অখণ্ড ভারতের মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেছিলেন। তাঁর কথা তখন আর কে শোনে, তাঁকে বিগ্রহ বানাতে প্রস্তুত তখন মাঝারি দেশনেতারা। তিনিও হয়তো তখন তাঁর বিখ্যাত পোজগুলি দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। জিন্না সাহেবও খেদের সঙ্গে বলেছিলেন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব ছিল না, কারণ কোনো হিন্দু নেতারই সদিচ্ছা ও কর্তৃত্ব ছিল না।’ তাই হয়তো ইতিহাসের গতিপথ পালটে দেওয়ার কৃতিত্ব তাকে দেওয়া হল, মানচিত্র পালটে দিলেন, দুহাজার মাইল দূরত্বের এক অবাস্তব জাতিরাষ্ট্র গঠনকেও বাস্তব বলে ধন্য ধন্য করা হল।

 ভারতবর্ষে তখন দেশনেতার বড়ই অভাব, সবাই কনুই দিয়ে এ ওকে গুঁতোচ্ছে। আর বঙ্গপ্রদেশও তথৈবচ। রবীন্দ্রনাথ নেই দেশবন্ধু নেই সুভাষচন্দ্র নেই নজরুল থেকেও নেই। চূড়ান্ত অবিশ্বাস আর লোভ থেকে রক্ষার উপায় নেই। হিন্দুর হাতে রাজ্যপাট দিলে মুসলমানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, আবার মুসলমান প্রধানমন্ত্রী হলে হিন্দুকে নামাজ পড়তে হবে। বরং দুভাগ হলে কর্মসংস্থান হবে, দুদিকে দুই রাজধানি, দুই রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী সাস্ত্রী সচিবালয়। রাজনীতির ঘোলা জলপানি তখন।

  বাঙালির জাতীয় চরিত্রে মারামারি হানাহানির ইতিহাস বড়ো কম। তাই বিস্মিত হতে হয় কী করে যে নোয়াখালির দাঙ্গা হয়, কলকাতায় হয় দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। দেশভাগের অব্যবহিত পরে আসাম প্রদেশ থেকে ভুল গণভোটে ছিটকে যাওয়া