পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪২

সিলেটের চা শিল্পের দেশ শ্রীমঙ্গলের রেলস্টেশনে হয় নৃশংস নরসংহার। কারণ ইতিহাস দুরকমভাবে গড়ে উঠেছে ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে, পুর্বে আর পশ্চিমে। পশ্চিমের নৃশংসতার কাছে কলকাতা নোয়াখালি শ্রীমঙ্গল তো নিতান্তই ছোটো ঘটনা। ঔপন্যাসিক আঁচল মালহোত্রার বর্ণনায় শিহরিত হতে হয় যখন এপার থেকে ওপারে প্রায় সমহারে যাচ্ছে শরণার্থী বোঝাই ট্রেন। রেলগাড়ির ভিতরের বর্ণনায় উত্তেজনা, ‘প্রতিবার যখন এক একটি স্টেশনে থামছে ট্রেন, আমরা বন্ধ দরজার ভিতর চুপ করে থাকি যাতে কোনো শব্দ বাইরে না যায়। আমরা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। বন্ধ কামরার ভিতর থেকে আমরা শুধু শুনতে পাই হিন্দু জল আর মুসলমান পানির আওয়াজ এমাথা থেকে ওমাথায় ঘুরছে। শুধু দেশ নয়, তার অধিবাসী নয় এবার জলও বিভাজিত হয়ে গেল।’

 নিষ্ঠুর পরিহাসপ্রিয় দেশভাগের ‘ইতিহাস’কে খলনায়ক করে প্রিয় লেখক গুলজার সাহেবের মন্তব্য আরও সুচিমুখ,

 ‘উদ্ধত এবং অহংকারী ইতিহাস যখন মেঘের কোলে মুখ লুকোয় সে তো আর নিচের দিকে তাকিয়েও দেখে না, বুঝতেই পারে না কখন তার পায়ের নিচে লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ দলিত হয়ে গেছে। সে বুঝতেই পারে না পাহাড় কেটে দুভাগ করা যত সহজ মানুষের ক্ষেত্রে তত সহজ নয়, মানুষ রক্তাক্ত হয়।’

 গুলজার কথিত রক্তক্ষরণ শুধু দেশভাগেই শেষ হয় নি, ভাগের দেশ ভারতবর্ষের আর এক রাজনৈতিক বিভাগ আসাম প্রদেশের বাঙালিরা এখনও ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে, পুর্বপুরুষের ভুলের মাশুল দিয়ে যাচ্ছে। ১ নভেম্বর ২০১৮-য় আপাতত শেষ কিস্তির পাঁচজন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে রক্তঋণ শোধ করলেন উজান আসামের ধলা শহরে। ভারতের নাগরিক প্রমাণ করতে না পেরে যারা প্রতদিনি আত্মহত্যা করে চলেছেন তাদেরই বা রক্ষা করবে কে। এই উদ্ধত এবং অহংকারী ইতিহাসকেও এবার ধৈর্য ধরে শোনতে হবে অপর এক বাঙালির অপার লাঞ্ছনার কথা।

 ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশের সঙ্গে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হয়। ১৮৩৬-এ বাংলাকে আসামের রাজ্যভাষা করে দেয় ইংরেজরা। বাঙালির আসামে মূল প্রব্রজনের শুরুর সময়কালও তাই ধরে নেওয়া যায় ১৮২৬। তখন পূর্ববঙ্গ থেকে বহু চাষি জমিদার মৌজাদাররা আসামে এসে বসবাস শুরু করে, যাদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। ব্রিটিশের সহযোগী হিন্দুবাঙালি বা বাবুবাঙালি সমাজেরও উদ্ভব হয় আসামের শহরগুলিতে। সেই সময় থেকে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি বাংলার সাহচর্যে নিজের পরিচিতি তৈরি করছে। নইলে কেন সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া কলকাতায় পড়তে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবেন, প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করবেন। উনিশ শতকের শেষদিকে আসামের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী গুণাভিরাম বড়ুয়ার পুত্রের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনির বিয়ে পর্যন্ত হয়, প্রব্রজন নিয়ে তিনিও বলেছেন—‘এরকম