পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪৩

অভিবাসন খুবই ইতিবাচক।’ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯২১-এ আর এক বুদ্ধিজীবী জগন্নাথ বেজবরুয়া বলেছেন, ‘অভিবাসনের ফলে বরপেটার প্রচুর উন্নতি হয়েছে।’ দুঃখের বিষয় এর পরের দশক থেকেই শুরু হয় উলটো পুরাণ। রাজনৈতিক প্রচার ও পরিসংখ্যানের কারচুপিতে চোখের মনি বাঙালি হয়ে যায় অসমিয়া জাতির চোখের বালি। দেশভাগের পর স্বাভাবিক কারনেই শরণার্থীর আগমন হতে থাকে আসামে যেহেতু পাকিস্তান গঠন ছিল মূলত ধর্মীয় প্রস্তাবের বাস্তবায়নে। বাঙালির বোঝা কমাতে গিয়ে তো উলটো হয়ে গেল সব, নিরঙ্কুশ হওয়া আর হল না। তখন থেকেই শুরু বাঙালির প্রতি বিভাজনের রাজনীতি। সেই সময়, দেশভাগের অব্যবহিত পর থেকেই আবার অসমিয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বাঙালি নিয়ে বিভ্রান্ত। তখন নিম্ন আসামে মুসলমান প্রব্রজন নিয়ে আনন্দিত জাতীয়তাবাদী আসাম। নেতারা বললেন—'নিরক্ষর মুসলমানরা আসামে স্বাগত, ওরা অকারণ রাজনীতিতে নাক গলায় না, অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির উপর চড়াও হয় না, বরং ওরা নিজেদের অসমিয়া পরিচয় দিতেও রাজি হয়ে গেছে।’ তৎকালীন কামরূপ গোয়ালপাড়া জেলা বাঙালি মুসলমান প্রধান হয়ে যায়। হিন্দু অনুপ্রবেশ নিয়ে হয় মাথাব্যাথা, ওদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত। বাঙালি মধ্যবিত্তরা সব কিছুতে মাথা গলায়। ওদের জন্যই মূলত শুরু হয় শহরভিত্তিক বিতাড়ন প্রকল্প, বঙ্গাল খেদা। আসামের বিখ্যাত সাহিত্যিক বিরিঞ্চি কুমার বড়ুয়া তখন জাতির শুদ্ধিকরণে ব্যস্ত। বললেন, ‘সাংস্কৃতিক জাতিগত ও ভাষাগত দিক দিয়ে প্রত্যেক অনঅসমিয়া আসামের কাছে বিদেশি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আসাম কখনই ভারতের অংশ ছিল না।’ কিন্তু বাঙালি যে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক থেকে আসামের নাগরিক সমাজ আলো করে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসে, আর ব্রহ্মদেশ থেকে আহোমদের আগমন তো সেদিন, ১২২৮-এ।

 গণভোটে সিলেটের ওপার বাঙালি কিন্তু নির্বিঘ্ন দেশ পেল না, ভেঙে টুকরো করা হল। বড় অংশ গেল পাকিস্তানে, তিন থানা আর অর্দ্ধেক ভারতে এলো। পাকিস্তানপন্থীরা তো হাইলাকান্দিও চেয়েছিল, সে ভিন্ন ইতিহাস। তখন কত গান, দুঃখের ছড়া,

‘ভেঙে দিও না সোনালি সিলেট।’
‘আসাম ছেড়ে ভঙ্গুর বাংলায় যেয়ো না।’
‘পূর্ববঙ্গে যাব না নালিশাক খাব না।’
‘পূর্ববঙ্গে যাব না ঘোড়ার ঘাস খাব না।’
‘ও সজনী সিলেট ভেঙে গুড়া করতায় নি?’

 পাকিস্তান পন্থীরাও স্লোগান দিল,

‘আসামে আর থাকব না, মশার কামড় খাব না।’
‘আসামে আর থাকব না, পুলিশের গুলি খেয়ে মরব না।’
‘পাকিস্তান ঝিঙার ঝাড়, গাইয়ে খার বদলে চার’।