পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪৫

জওহরলাল নেহেরু দেশভাগের বেদনায় মধ্যরাত্রে বলেছিলেন ‘ওপারে আজ যারা আমার ভাইরা থাকলেন, আমাদের সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারলেন না, তারা আমাদেরই আপনজন। যখনই তারা এপারে চলে আসতে চাইবেন তাদের জন্য দ্বার চিরদিন উন্মুক্ত থাকবে। এখানে এসে ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য মর্যাদাই তারা ভোগ করতে পারবেন।’ এমনকি তাঁর মাতামহী ইন্দিরা গান্ধি পর্যন্ত আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুর আগে বলেছেন 'আসাম সমস্যার সমাধান শুধু আসু আর অগপর ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ করে হবে না। আসামে বসবাসকারী সকল শ্রেণীর নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হতে পারে।’ এও হল আর এক ধরনের পারিবারিক পরিহাস।

 চুক্তি তো হল, বাঙালি বিদেশি চিহ্নিত হল কই। আইএমডিটি আইন মানে Illigal Migrants (Determinations by Tribunal) Act 1983-এ নাকি যথেষ্ট ফাঁকফোকর আছে, তাই বাঙালিকে বিদেশি চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। সেই মর্মে তখনকার আসু সভাপতি বর্তমান বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে নালিশ করলেন যাতে ফাঁক ভরাট করতে আইনটি বাতিল করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আইএমডিটি বাতিল হয়। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবায়নের কাজ শুরু হয়, যার পারিভাষিক গিলোটিনের নাম এনআরসি। একেবারে জার্মানির মডেলেই, সমাজতন্ত্রী নায়ক হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে তৈরি হয় ডিটেনশন ক্যাম্প। খাদ্য বস্ত্র ছাড়া কিছুই দেওয়া হবে না বন্দীশালায়। ভারত প্রজাতন্ত্রে অনেক কিছুই হয় সৃষ্টিছাড়া, ভোটার তালিকায় ট্যাড়া দেওয়া হয় ‘ডি’, মানে ডাউটফুল, সন্দেহজনক, সন্দেহ দূর করতে না পারলে সবরকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাড়ানো হবে দেশ থেকে। আর নাগরিক পঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি, যার মধ্যে একজন আসামেরই সম্মানিত ভূমিপুত্র। এখন তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর নাগরিক পঞ্জির প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়, যাতে এক কোটি উনচল্লিশ লক্ষ নাগরিকের নাম নেই, যার সিংহভাগ নামহীনরাই বাঙালি। সেই পোকায় কাটা নাগরিক পঞ্জিতে বিচ্ছিন্নতাবাদি নিষিদ্ধ দল আলফার শীর্ষনেতাদের নাম আছে, কিন্তু নাম নেই অনেক বিশিষ্ট বাঙালির। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম নেই, কী আশ্চর্যের ব্যাপার শ্রীভট্টাচার্যের পিতা শ্রীতারাপদ ভট্টাচার্য ছিলেন আসামের একজন শ্রদ্ধেয় জননেতা এবং বিধায়ক। নাম নেই আর এক প্রাক্তন বিধায়কপুত্র বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সঞ্জীব দেব লস্করের পরিবারের নামও, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ সম্পাদক তইমুর রাজা চৌধুরীর নামও।

 আসামের বুদ্ধিজীবী সমাজ এখন জাতীয়তাবাদের অন্ধতায় আক্রান্ত। উনবিংশ শতাব্দীর মুক্তমনা সমাজের বিলয়ের ফলে এখন আর আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন কিংবা গুণাভিরাম বরুয়ার জন্ম হয় না। আসামের বামপন্থাও ভুল জাতীয়তার যাঁতাকলে বিদ্ধ,