পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৪৯

থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। যদিও বাঙালি জানে খাদের কিনারায় গেলে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে, যদি না রাষ্ট্র তার নাগরিককে সুরক্ষা দিতে পারে। হিন্দু মুসলমান বিভাজন না করে। ভাওতায় বলা হচ্ছে হিন্দুদের ভয় নেই, ওরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে। মুসলমানদের ফিরে যেতে হবে। এখন আরএসএস পড়েছে ফাঁপড়ে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে তো তা সম্ভব নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তথৈবচ, ভোট বড় বালাই। কংগ্রেস আর বামপন্থীদের অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল, বরাক উপত্যকায় একরকম ব্রহ্মাপুত্রয় ভিন্ন। সংখ্যাগুরুকে ছেড়ে যায় না ভোটের কাঙালি। তার মানে, অসহায় বাঙালিকে একা চলতে হচ্ছে, তোর ডাক শুনে যদি কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। গণতন্ত্রের চার চারটি স্তম্ভই আসামে নড়বড়ে, বাঙালির বিপক্ষে। তবুও অনন্ত জাগে। আছে ভারতের সংবিধান গ্রন্থিসূত্র হয়ে। তাই হয়তো সাময়িক মানসিক যন্ত্রনায় ফেলা যাবে, নিঃশেষ করা যাবে না পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠীকে।

 আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে বাঙালি। বিশ্ববরেণ্য কথক কাফকার মোক্ষম উচ্চারণ ছিল তাঁর সৃষ্টিতে এক রূপক অণু আখ্যানে। হয়তো লেখকের ব্যক্তিগত সংকটের কথাই রহস্যের মোড়কে ঢেকে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জার্মান ভাষার সাহিত্যিক। জন্মেছিলেন দেড়শ বছর আগে বোহেমিয়ায়। তার মাতৃভাষা কিন্তু জার্মান ছিল না, আসামেও অনেক বাঙালি যারা অসমীয়া বাংলা দুই ভাষায় লিখেছেন এখনও লিখছেন, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন অসমিয়া থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। সেই বোহেমিয়ায় জন্ম লেখকের ইহুদি হওয়ার জন্য জার্মানিতেও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে ছিলেন, গেস্টাপোরা তার লেখালেখি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবু তিনি জার্মান ভাষার আনুগত্য ছাড়েন না, মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন যে। তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল, পিতার সঙ্গে অবনিবনা, সুস্বাস্থ্যও ছিল না, টিবি রোগী ছিলেন, প্রেম করেছেন গণ্ডায় গণ্ডায়, বিয়ে করতে ভয় পেয়েছেন, বেশ্যাগমন করেছেন। আবার প্রিয় বন্ধুতে অনুগত থেকেছেন। একটি কল্পিত বিচারের আখ্যান কথা লিখেছেন। মানবিক সম্পর্কের ক্ষয় দেখাতে যুবা নায়কের মাকড়সার মতো পোকায় রূপান্তরের গল্প লিখেছেন। সেই তিনি একসময় দুম করে বলে বসলেন, চলে যাবেন তেল আবিব, নিজের দেশ গড়তে দেশ খুঁজতে চলে গেলেন, নিজের মাতৃভাষা হিব্রুতে লিখতে শুরু করলেন। তারপর একসময় ক্ষয়রোগে মারাও গেলেন। বন্ধুকে বলেছিলেন মৃত্যুর পর যেন তার সব লেখাপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়, বিশ্বসাহিত্যের পাঠক সেই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি কথা রাখেননি। তাঁর রচনা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে নিরসনের পথ খোঁজার চেষ্টা করতে পারছি। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে জন্মালেন, লিখেছিলেন মানবিকতার অমানবিক মুখ।

 আসল কথা, শোনাতে হবে, বলার মতো করে বলতে হবে, যার যেমন অস্ত্র তাই