পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৬২

প্রয়োগবিধির মাধ্যমে। বিধির বাঁধন থাকে, আঞ্চলিক কথ্যভাষা যেহেতু ‘মৌখিক এবং অনাচারিক’ মূলত, তাই মৌখিক ভাষায় বর্জ্যও থাকে। ধর্ম সাম্প্রদায়িকও হয়, ভাষাকে বদ্ধ করে। আবার অসাম্প্রদায়িক রূপও আছে, যার মনে যেমন। আঞ্চলিক উপভাষার সাম্প্রদায়িক প্রয়োগ সর্বার্থে বর্জনীয়ও নয়, দোষণীয়ও নয়। বরাক উপত্যকায় হিন্দুমুখে ‘তুই’ শব্দ ‘তুই’ই থাকে, প্রান্তিক নিম্নবর্গের মুসলমান কিন্তু বলে ‘তুইন’। মুজিব ইরম স্ববৃত্তে আবদ্ধ হয়েছেন। লেখার ভাষা আরও মুক্তি দাবি করে। আবার মান্য লেখার ভাষায়ও রাষ্ট্রসীমা ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এপার বাংলার জলকে ওপারে বলে পানি, নিমন্ত্রণকে বলে দাওয়াত, জলখাবারকে নাস্তা, দিদিকে আপা, বাবাকে কোথাও কোথাও আব্বা। বাক্যগঠনেও বিভিন্নতা থাকে, ‘ফোন করা’কে ওপারে বলে ‘ফোন দেওয়া’। তাহলে। শিষ্টতায় কে ঠিক। এপার বাংলা ওপার বাংলা। একই ভাষা। একই ভাষার আলাদা সার্বভৌমত্ব। কিন্তু, বরাক উপত্যকার বাংলায়, তথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলায় রয়েছে এক কৃত্রিম পরাধীনতার জ্বালা, আসাম রাজ্যের রাষ্ট্রশক্তির ক্রমাগত তর্জনি নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে ভাষাকে। মাতৃভাষাকে সচল রাখতে বরাক উপত্যকার ভাষামানুষ বারবার রক্ত ঝরিয়েছে। শহিদ হয়েছে। তাই, এ উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষার অবস্থান স্বতন্ত্র। এখানে, এই দুর্দশাগ্রস্ত ভাষাকে বহমান রাখছে তার আঞ্চলিক উপভাষাভাষী মানুষ, তাদের মুখের ভাষায়, বুকের রক্তে।

 ত্রিপুরাতেও বাংলা ভাষার এক নতুন আঞ্চলিক রীতির প্রবর্তন হয়েছে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেটের উপভাষা মিলে তৈরি হয়েছে নতুন আঞ্চলিক উপভাষা। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমান্ত পেরিয়ে এ সমাচার রাজার কানে পৌঁছতে সময় লেগে যায় বিস্তর। অপরিচয় কমে না। এখনও, এপারের পশ্চিমবাংলায় কেউ বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষায় কথা বললে, পাশাপাশি শ্রোতার কৌতূহলে হয় কৌতুক, এ কে রে বাবা। এ তো শুদ্ধভাষায় কথা বলছিল, এখন এ কোন সংকেতে কথা কয়। আপনি কি অসমিয়া। আপনি ত্রিপুরা ছিলেন। ত্রিপুরা চেনে, আসামও চেনে, বরাক উপত্যকা চেনে না। কৌতুক পাল্টে বলা যায়, আসাম ও চেনে না, ত্রিপুরা চেনে না, বরাক উপত্যকা তো নয়ই।

 এবার লেখকের বিড়ম্বনা। এক, কথাসাহিত্যের বর্ণনায় না হয় শিষ্টচলিত কিংবা সাধুভাষার প্রয়োগ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সংলাপে যখন বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ হবে, তখন। এপার বাংলা এবং সিলেট ছাড়া ওপার বাংলার পাঠকের কী হবে। সংযোগ কোথায়। ‘রসগ্রহণের ব্যাঘাত’ দূর করার উপায়। বরাক উপত্যকায় যে মোচাকে ‘থোড়’ বলে, লঙ্কাকে মরিচ বলে। কী করে পৌঁছয় তবে কণ্ঠস্বর। রস, রূপ, বর্ণ ও গন্ধসহ লেখা কী করে পৌঁছে একই ভাষাপাঠকে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। তাহলে কি চলতেই থাকবে একমুখি যান চলাচল। বরাক উপত্যকাই পড়বে দুই ভুবনের রচনা, ভুবনধর প্রধানদের কোনো দায় নেই। তাহলে কি আত্মসমর্পণই