পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ধ্রুবপদ উনিশ

পঞ্চাশ বছর আগে, এগারো বারো বছরের প্রাক্‌কৈশোর শিশুমনে ভাষা আন্দোলনের মাত্রা ছিল এক নৈঃশব্দ্যের বিস্ফোরণ। এক বিশালের আবির্ভাব। এক প্রবল উন্মাদনা, মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসার জ্ঞানোন্মেষ। পরিবার পরিজনসহ গোটা সমাজই বাঁধা পড়েছিল এক সূত্রে। লক্ষ প্রাণ গেয়ে উঠেছিল একই সুরে ভাষাবন্ধনের গান,

‘নওজোয়ান নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান
একই প্রাণ কোটি প্রাণ, একই শপথে বলীয়ান
আমাদের মুক্তি স্বপ্নে সূর্যে রঙ লাগে
যৌবনের অভ্যুদয় হিমালয় জাগে।’

 উত্তরাধিকার বহন করার এক অলৌকিক মাধ্যম হয়েছিল ভাষা আন্দোলন।

 এক বিস্তীর্ণ নদী-উপত্যকা ঘিরে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল ১৯শে মে ১৯৬১ তে, বর্তমান একষট্টির সেই শিশুর বয়স তখন ওরকম, এগারো, বারো ছুঁই ছুঁই। কাছাড় হাইস্কুলের সপ্তম মান শ্রেণি। আর তার জ্যেষ্ঠ, টগবগে কিশোর, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষা শেষ হয়েছে আঠারোই মে। উনিশ থেকে সংগ্রাম। মুখের ভাষা কেড়ে নিলে কী হয়, তখনও স্পষ্ট নয় শিশুমনে। তবে মাতৃভাষা যে মায়ের মতো সে-শিক্ষা হয়ে গেল প্রথম দিনেই। নইলে কেন জ্যেষ্ঠভ্রাতার স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যাওয়া আর তার না হওয়ায় এত মন খারাপ। মনোদুঃখ সামাল দিতে শেষপর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক অভিজ্ঞানসূচক কার্ড একটা পাওয়া গেল লেবার অফিসে মোতায়েন থাকার। শিশু জানত মুখের ভাষা ফিরে পাওয়ার এই আন্দোলনে সামিল হওয়ার, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার শাস্তি বেশি হলে একটু বকাঝকা হতে পারে, যেমন হয় মাছের মুড়ো নিয়ে দাদাভাই-এর ঝগড়ায়। কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি খুনখারাবির কথা, রক্ত বরাকের কথা। এগারোজনের শহিদ হওয়ার কথা। কী করে ভাববে শান্তির উপত্যকা বরাক নদীর কূলে যে তখন চিরবিরাজমান কল্যাণ।

 তখন এই উপত্যকার গ্রাম শহরে মানুষের ভিড় ছিল না তেমন। বাণিজ্য নগরী হয়ে ওঠেনি শহর শিলচর। আর্য্যপট্টি, অম্বিকাপট্টি, এই দুই সাংস্কৃতিক এলাকায় বিভাজিত ছিল শহর। সামাজিক পরিমণ্ডলে বহমান ছিল বাঙালিয়ানা। মধ্যশহরের বাণিজ্যিক পরিবেশেও ছিল ভরপুর সংস্কৃতি ও সাহিত্য। সারা ভারতের গুণী শিল্পীরা রাতভোর গাইতেন শীতে। গোলদীঘিতে রাণারের গান গাইতেন হেমন্তকুমার, নট্ট কোম্পানির