পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৬৫

যাত্রা হত সোনাইদীঘি। স্থানীয় নাটকের স্তম্ভ ছিলেন নীলুদা, পান্নাদা, পলু বিশ্বাস। কলকাতার প্রযুক্তি দিয়ে সেতু, অঙ্গারের মতো নাটক হত। সেণ্ট্রাল রোডের কবিরাজ বাড়িতে ছিল নাচগানের ভরা কোটাল। নাচরাজ্যের রাজপুত্র ছিলেন মুকুন্দদা। সমাজকে শাসন করত সমাজ। পুলিশ প্রশাসন আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাপাদাপি, আস্ফালন ছিল না দৃষ্টিকটু। চিণ্টুদা, রুণুদাদের কণ্ঠশাসনে শিশু ঘুমিয়ে পড়ত হাসিমুখে। একচ্ছত্র ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন মহীতোষ পুরকায়স্থ, নন্দকিশোর সিংহ, জ্যোৎস্না চন্দ, তারাপদ ভট্টাচার্য, হুরমত আলির মতো নেতৃত্ব। সর্বজন গ্রাহ্যতায় তাঁরা ছিলেন নেতা।

 মুক্ত সমাজের এই উত্তরাধিকার হরণ করতে চাইল ‘গণতন্ত্রী’ এক সরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটাধিকার বলে রবীন্দ্রনাথের মুখের ভাষা মুছে দিতে চাইল বরাক উপত্যকা থেকে। সংস্কৃতিবান বাঙালির অহিংস সংগ্রামের জবাবে সদ্য ম্যাট্রিক দেওয়া ছাত্র শচীন্দ্র পাল, কমলা নামের এক পারুল বোন সহ এগারোজনের আত্মত্যাগের ইতিহাস ঘোষণা করল মাতৃভাষার অমরতা। জানিয়ে গেল বাঙালি ধমনীর স্বতশ্চল ধারার নাম উনিশে মে। জানিয়ে গেল উনিশে মে কোনো বাৎসরিক স্মরণ উৎসব নয় শুধু। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করেছিল যে উনিশে মে, সেই উনিশের চেতনাই দিতে পারে তার সুরক্ষাও।

 ইতিহাস লুণ্ঠনের চেষ্টা হয়েছে বারবার। কোনো অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মহিমের অসম্মান করেছেন কেউ কেউ। ধ্রুবপদ পাল্টে দিতে চেয়েছেন। ইতিহাসের পুনর্বিচার, পুনর্লিখনের নামে বিবাদের সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝপথে ইতিহাসের সমিধ হারিয়ে যাচ্ছে, আর নেপো ও কালাপাহাড়দের উৎপাতে মাতৃভাষার নামে এক কৃত্রিম, বিকৃত ভাষার সৃষ্টি হচ্ছে। বিজ্ঞাপনপত্র, এটিএম আদির দ্বিভাষিক লেখায় বাংলা নয়, অসমিয়ার পরাক্রমী দাপাদাপি। আইচি আইচি আই, ইঞ্চুরেনছ এবং পেটকাটা র। টুনির ‘ডেটিং' গানও এখন ঘরে বাইরে। চ্যানেল সংস্কৃতির টিআরপি চালিত ত্রিভাষাসূত্রে এখন হিন্দি ইংরেজির নব্য বং ভাষাই কি উনিশে মে’র উত্তরাধিকার।

 শুধু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তো কোনো সমাধান হয় নি কোনো কালে।

 নয়া বাংলার এই ভূত তাড়াতে তাই এবারের সংগ্রাম নিজের সঙ্গেই।

 তাই, ভাষাপ্রেমী দরদিজনের কাছে এরকম আবেদন কি একেবারেই অবাস্তব, যদি বলা যায়,

 * পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রে মাতৃভাষার শুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি সংসদ গঠিত হোক।

 * উনিশে মে’র পঞ্চাশ বছরকে মাতৃভাষা সুরক্ষা বছর হিসেবে পালন করা হোক।

দ্বিরালাপ ৪৮ জুন ২০১০।