পাতা:উনিশে মে- ভাষার সংকট - রণবীর পুরকায়স্থ (২০২১).pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উনিশে মে : ভাষার সংকট □ ৬৮

রাজপরিবারে প্রিয় নাতিরাও যে পারসিক, সুদূর ইরান। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গুজরাট ভারুচের বাসিন্দা হয়ে যান রাজবদান্যতায়, ঘাণ্ডি থেকে গান্ধিও হয়ে যান মহাত্মাজির অনুপ্রেরণায়, সৌজন্যে। তখনও ছিল অনুপ্রেরণা। ভারতে উদার ঐতিহ্য আর দেশাত্মবোধ সবাইকে এক দেহে লীন করে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য শুধু বাঙালির, স্বাধীনতার আগে থেকেই অসমীয়া উগ্র জাতিয়তাবাদের শিকার হয়েছে বাঙালি। দেশভাগের পরপরই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আর এক প্রিয়জন, আসামের রাজ্যপালও নির্ধারিত করে দিলেন বাঙালি শূন্য ভবিষ্যৎ আসামের রূপরেখা। বললেন, যাক বাঙালি আর থাকল না সব কিছুতেই তাঁর দীর্ঘ নাক গলানোর জন্য। এসব কথা যখন বলা হচ্ছে তখন অসমিয়া আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী বটে, কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়। নিঃসপত্ন ভাষাগোষ্ঠী হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল উগ্রতার, খাসি মিজো নাগা মনিপুরিকে আলাদা করতে হল, তাও কী হয়, একশ বছরের বেশিদিনের বাসিন্দা বাঙালি মুসলমানদের প্রশাসনিক কারসাজিতে অসমিয়া সাজানো হল। এতসব অনৃতায়নের পর অসমিয়ার গরিষ্ঠতা সীমিত হয়। নিরঙ্কুশ হয় না। ইতিমধ্যে অধুনার বরাক উপত্যকায় খাল কেটে কুমির আনার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয় ১৯৮৫-তে। তৎকালীন কাছাড় জেলার বদরপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে উপত্যকার শিবসাগর জেলার সোনারি বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে যাওয়া কংগ্রেস নেতা বিমলা প্রসাদ চালিহা নির্বাচিত হন একশ শতাংশ বাঙালির ভোটে কাছাড় জেলার বদরপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এবং সেই জয়সুত্রে আসামের মুখ্যমন্ত্রীও হয়ে যান বিষ্ণুরামকে মাদ্রাজ সরিয়ে দিয়ে। বাঙালির ভোটে জেতা মুখ্যমন্ত্রী মসনদে বসেই বলে বসলেন অসমিয়া হবে রাজ্যের রাজকীয় ভাষা, ইংরেজি হবে সংযোজক ভাষা সাময়িকভাবে। সেই মতো আইনও হয়ে যায় বিতর্কিত ভাষা আইন ১৯৬০। বরাক উপত্যকা সরব হয়ে ওঠে কালা আইনের বিরুদ্ধে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়ও বাঙালি বিদ্বেষ উত্তাল তখন। যার ফলশ্রুতিতে বরাক উপত্যকায় শুরু হয় সর্বাত্মক হরতাল, ১৯ মে ১৯৬১ ইংরেজিতে। এগারোজন শহিদের রক্তে ভাষাবেদি সিক্ত হয় সেদিন। কিছুটা হলেও দিল্লির টনক নড়ল, নেতারা এলেন মাঝারি, লালবাহাদুর এলেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী এলেন না, তিনি গৌহাটিতে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করে গেলেন দুর্গাপুর। সারা ভারত কংগ্রেস দলের অধিবেশন যে ওখানে। শোকজ্ঞাপন করলেন নেতারা, কুট্টি আঁকলেন তার বিখ্যাত কুম্ভীরাশ্রুর কার্টুন। ভাষা বিল সংশোধিত হল, বরাক উপত্যকার জন্য রইল বাংলা ভাষা। নাকের বদলে নরুন। আইন লঙ্ঘনের চেষ্টাও হতে থাকল বারবার। বরাক উপত্যকাও প্রতিবাদে গর্জে উঠল। রাজশক্তি দেখল, এতো মস্তো বড়ো গেরো, মরিয়া না মরে এ কেমন বৈরী। তখন নতুন উপায়ে বাঙালি বধের আয়োজন হতে থাকল, আরও দু’দফায় ভাষা শহিদ হলেন তিনজন। ইতিমধ্যে ওপারের স্বজনরা যখন অত্যাচিরত হয়ে দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন সামরিক শাসনের নির্মময়তায়, তারা নিশ্চিন্তে এসে বসবাস শুরু করেছেন পিতৃভূমিতে।