পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

থাকিবে। আমাদের যাহা কিছু আছে তাহা ব্রাহ্মণদিগকে, চাকব বাকরকে, আর গরিব দুঃখীকে বিলাইয়া চল আমরা শীঘ্র বনে যাই।’

 লক্ষ্মণ রামের আগেই সেখানে আসিয়াছিলেন। রাম সীতার কথাবার্তা শুনিয়া তিনি বলিলেন, ‘দাদা, যদি যাইবেই, তবে আমি ধনুক বাণ লইয়া তোমার আগে আগে যাইব। আমি তোমাকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিব না। রাম বলিলেন, সে কী ভাই, তুমি যদি যাও তবে মা কৌশল্যা আর মা সুমিত্রাকে কে দেখিবে?’ লক্ষ্মণ বলিলেন, মা কৌশল্যার জন্য কোন চিন্তা নাই। আর তিনি এত লোককে খাইতে দিতেছেন, তিনি কি মা সুমিত্রাকে দুটি ভাত দিতে পরিবেন না? দাদা, আমাকে সঙ্গে লও। আমি রোজ তোমাদের ফলমূল আনিয়া দিব।’

 সুতরাং লক্ষ্মণকে সঙ্গে লইতে হইল। লক্ষ্মণ দেখিতে দেখিতে সকলের নিকট বিদায় লইয়া অস্ত্রশস্ত্র বাঁধয়া প্রস্তুত। তারপর যাহাকে যাহা দিতে হইবে রামের কথামত সকলকে তাহা দিতে লাগিলেন। চাকরেরা যাহা পাইল তাহাতে তাহাদের চিরকাল সুখে কাটিবে। তাহা ছাড়া আবার রাম তাহাদিগকে বলিলেন, যতদিন আমরা ফিরিয়া না আসি, ততদিন আমাদের বাড়িতেই থাক।’

 সে দেশে ত্রিজট নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ঠাকুরটি বুড়া যতদূর হইতে হয়, আবাব গরিব তাহার চেয়েও বেশি। সেই ব্রাহ্মণ রামের দানের কথা শুনিয়া কিছু ভিক্ষাব জন্য আসিয়া উপস্থিত। রাম তাঁহাকে দেখিয়া হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি এই লাঠিটা যত দুর ছুড়িয়া ফেলিতে পরিবেন, তত দূর পর্যন্ত আমার যত গরু আছে সব আপনার।’

 সেই বুড়া বামুনেব গায়ে কী জোরটাই ছিল! তখন তিনি কসিয়া কোমর বাধিয়া, ‘হেঁই— হো’ শব্দে লাঠিগাছটাকে একেবারে সরযু পার করিয়া দিলেন। ততদূব অবধি গণিয়া দেখা গেল, এক লক্ষ গরু। রাম ইহাতে যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হইয়া সেই লক্ষ গরু তো তাঁহাকে দিলেনই, তাহা ছাড়া আরও অনেক ধন দিলেন।

 এইরূপে সমস্ত ধন দান করিয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা দশরথের সহিত দেখা করিবাব জন্য পথ দিয়া হাঁটিয়া চলিলেন। তাহা দেখিয়া সকলে বলিতে লাগিল, ‘হায় হায়, যে রাম কখনও একা পথ চলেন নাই, যে সীতা কখনও ঘরের বাহির হন নাই, আজ কিনা তাঁহারা এমনভাবে পথ হাঁটিয়া চলিয়াছেন! দশরথকে নিশ্চয়ই ভূতে পাইয়াছে, নহিলে এরূপ হইবে কেন? এ দেশে আমরা আর থাকিব না। চল আমরা রামের সঙ্গে বনে চলিয়া যাই কৈকেয়ী তাঁহার ছেলেকে লইয়া এইখানে পড়িয়া থাকুক!'

 রামকে বিদায় দিতে দশরথের কিরূপ কষ্ট হইয়াছিল, তাহা আর আমি লিখিয়া কত জানাইব? কৈকেয়ীর ছল বুঝিতে না পারিয়া তাঁহাকে বর দিয়া বসিয়াছেন, কাজেই এখন আর নিজে কী করিয়া না’ বলেন। কিন্তু রাম তাঁহার কথায় বনে যান, ইহা তাঁহার একেবারেই ইচ্ছা নহে। তাই তিনি রামকে বলিলেন, বাছরে, তুমি আমাকে বধিয়া রাখিয়া নিজে অযোধ্যার রাজা হও। রাম বলিলেন, বাবা, আপনি আরও হাজার বৎসর বাঁচিয়া থাকিয়া সুখে রাজ্য করুন। আমি রাজ্য চাহিনা। আমি বনে গিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা রাখিয়া, তারপর আবার আপনার পায়ের ধূলা লইতে আসিব।’

 আর একটি দিন রামকে রাখিতে পারিলেও হয়ত দশরথের মনে কতটা আরাম হইত। কিন্তু আর একটি দিনও তাঁহাকে রাখিবার উপায় নাই, কারণ সেইদিনই তাঁহার যাইবার কথা।