পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০০৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

কড়ি আনিয়া বেচিতে চাহিবে, না হয় বলিবে, ‘পানিমে যায়গা?’অর্থাৎ তুমি যদি একটা পয়সা দাও, তবে সে সমুদ্রের জলে নামিয়া তোমাকে কিছু তামাশা দেখাইতে প্রস্তুত আছে। তুমি রাজি হইলে উহারা নানারকম সাঁতার কাটিয়া দেখাইবে। রাজি না হইলে বার বার ঐ কথা বলিয়া তোমার কান ঝালাপালা করিয়া দিবে। তাহাতেও কাজ না হইলে ভেংচি কাটিয়া ডিগবাজি খাইয়া তোমাকে খ্যাপাইয়া তুলিবে। একদিন ইহারা একটা সং লইয়া আমাদের বাড়িতে আসিয়া বেজায় সোর সরাবৎ আরম্ভ করিয়া দিল। গোলমালের জ্বালায় অস্থির হইয়া আমি বাহিরে আসিয়া দেখি, একটার গায়ে ঘাস জড়াইয়া সেটাকে এক অদ্ভুত জন্তু সাজাইয়াছে, আর সবগুলি মিলিয়া তাহাকে লইয়া কোলাহল করিতেছে ইচ্ছ, কিছু বকসিস আদায় করে। আমি তখন একটা দরকারি কাজে ব্যস্ত ছিলাম, কাজেই বকসিস দেওয়া দুরে থাকুক, আমি তাহাদিগকে তাড়াইতে পারিলে বাঁচি। সুতরাং আমি করিলাম কি, ঘরের ভিতর হইতে মোটা লাঠিগাছ লইয়া, দাঁত মুখ খিচাইয়া, চোখ ঘুরাইতে ঘুরাইতে দুই লাফে একেবারে তাহাদের সামনে আসিয়া উপস্থিত। তাহারা তখন আমাকে ঝড়, না ভূমিকম্প, না ইঞ্জিন, না পাগলা হাতি, কি মনে করিয়াছিল তাহা উহারাই জানে, কিন্তু একবার আমাকে দেখিয়া আর কেহ দুবার দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিল না। সংটাই সকলের আগে ছুটিয়া পলাইল।

 বাস্তবিক সমুদ্রের ধারের অসুবিধার মধ্যে এই নরিয়া ছেলেগুলিকে ধরিলেও অন্যায় হয় না। ইহাদের লক্ষঝম্প দেখিয়া মাঝে মাঝে আমোদ বোধহয় বটে, কিন্তু স্ত্রীলোক অথবা নিরীহ লোক দেখিলে ইহারা অনেক সময় বড়ই অভদ্রতা করিয়া থাকে। আবার ইহাদের কোনো কোনোটার চুরির অভ্যাসও আছে।

 এবারেও যে সমুদ্রে স্নান করিয়া খুব আনন্দ পাইয়াছি তাহা বলাই বাহুল্য। এখনো আমার হাঁটুতে তাহার দাগ আছে। তিন মাসের মধ্যে একটি দিন মাত্র আমার স্নান বাদ গিয়াছিল সেদিন সমুদ্রে সাইক্লোন-হইতেছিল। তখন সমুদ্রের চেহারা দেখিয়া আর নামিতে ভরসা হয় নাই। তারপরেই পূর্ণিমার জোয়ার ছিল;তখনো সমুদ্র খুবই চঞ্চল, কিন্তু স্নান বন্ধ হয় নাই। তবে সেদিনকার সেই পাগলা ঢেউয়ের হাতে যে শক্ত দুইটা আছাড় খাইয়াছিলাম, তাহার কথা অস্বীকার করিতে পারি না। প্রথমে একটা ঢেউ আসিয়া আমাকে নাকি মুখ থুবড়িয়া দিয়া ফেলিয়াছিল। তাহাতে আমি একটু পিছন বাগে জোর করিয়া সাবধান হইলাম, যেন আর ধুবড়িয়া ফেলিতে না পারে। কিন্তু তাহার পরের ঢেউটা যখন আমাকে বালির উপরে চিৎ করিয়া ফেলিয়া কুড়ি হাত লম্বা বিষম এক ধাক্কা দিল, তখন বুঝিলাম যে এর চেয়ে মুখ থুবড়িয়া পড়া ঢের ভালো ছিল।

 সূর্য গ্রহণের দিন স্নানের ঘটা খুব বেশি হয়; এবারে সূর্যগ্রহণের সময় পুরীতে ছিলাম। গ্রহণ আরম্ভ হইবার পূর্বেই বিস্তর লোক আসিয়া সমুদ্রের ধারে জড় হইল। অমাবস্যার জোয়ারে সমুদ্রের তেজ খুবই বেশি হয়, কাজেই সেদিনকার গান খুব কষ্টকর হইয়া থাকে। কিন্তু গানের সময় উপস্থিত হইলে প্রায় কেহই কষ্ট অথবা বিপদের দিকে তাকাইল না। যাহারা নিজে স্নান করিতে পারে না, তাহাদিগকে অপর বলিত লোকেরা সাহায্য করিতে লাগিল। এক এক জায়গায় দেখিলাম, দশ-পনেরোজন হাত ধরাধরি করিয়া স্নান করিতে নামিয়াছে। আমার বোধহয়, সেদিন বেশি ভিড়ের সময় প্রায় কুড়ি হাজার লোক সমুদ্রের বারে উপস্থিত ছিল। সর্বসুদ্ধ যে ইহার অনেক বেশি লোকে স্নান করিয়াছিল, তাহাতে