শেষে দশরথ সুমন্ত্রকে বলিলেন, রামের সঙ্গে অনেক সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র আর গাড়ি ঘোড়া দাও। শহরের লোকেরা তাঁহার সঙ্গে যাউক। লোকজন, টাকাকড়ি কিছুতেই যেন তাঁহার কষ্ট না হয়।’
ইহা শুনিয়া কৈকেয়ী বলিলেন, ‘মহারাজ, সবই যদি রামের সঙ্গে পাঠাইবেন, তবে আমার ভরতের রাজা হইয়াই বা কী লাভ?
রাম বলিলেন, ‘বাবা, এ সকল কিছুই চাহি না। আমার একখানা খন্তা, একটি পেটরা, আর খানকতক ছেড়া ন্যাকড়া হইলেই চলিবে। এই কথা বলিতে বলিতেই কৈকেয়ী তিন টুকরা ন্যাকড়া লইয়া উপস্থিত। রাম, লক্ষ্মণ ভাল কাপড় ছাড়িয়া ন্যাকড়া পরিলেন। কিন্তু হায়, সীতা তো জানেন না কেমন করিয়া ন্যাকড়া পরিতে হয়! তিনি শুধু তাহা হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সুতরাং রামকেই নিজ হাতে সেই ন্যাকড়াখানা তাঁহার রেশমী শাড়ির উপরে জড়াইয়া দিতে হইল। তাহা দেখিয়া কাহার সাধ্য চোখে জল থামাইয়া রাখে।
তখন বশিষ্ঠ সীতাকে ন্যাকড়া পলাইতে বারণ করিয়া কৈকেয়ীকে অনেক বকিলেন। দশরথও বলিলেন, ‘সীতাকে ন্যাকড়া পরাইতে হইবে এমন বর তা আমি কখনও দিই নাই। সীতা সকল রকম ধনরত্ন সঙ্গে লইয়া যাউক। সকলেব শেষে রাম হাত জোড় করিয়া দশরথকে বলিলেন, মহারাজ, আমার দুঃখিনী মাকে দেখিবেন।
এদিকে যাইবার সময উপস্থিত। সুমন্ত্র রথ সাজাইয়া প্রস্তুত। সুতরাং তিনজনে সকলকে প্রণাম কবিয়া বিদায় লইলেন। রাণী সুমিত্রা তখন লক্ষ্মণকে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, ‘বাবা, তুমি রামের সহিত যাও। সকল সময় তাঁহার কাছে থাকিও। রাম ছাড়া তোমার আর কেহ নাই। রামকে মনে করিও যেন রাজা দশরথ, সীতাকে মনে করিও যেন আমি, আর বনকে মনে করিও যেন অযোধ্যা। যাও বাছা, মনের সুখে চলিয়া যাও।’
তারপর আগে সীতাকে সুন্দর কাপড় পরাইয়া রথে তুলিয়া দেওয়া হইল। পরে রাম লক্ষ্মণ অস্ত্রশস্ত্র, পেটরা, আর সীতার চৌদ্দ বৎসরের মতন কাপড় লইয়া তাঁহার সঙ্গে উঠিয়া বসিলেন। রথ চলিতে দেখিয়া সকলে পাগলের মত হইয়া তাহার সঙ্গে ছুটিল। যখন রথের সঙ্গে আর ছুটিতে পারে না, তখন তাহারা অতি কাতরভাবে সুমন্ত্রকে বলিতে লাগিল, ‘ও সুমন্ত্র, একটু আস্তে যাও! আমরা যে আর পারি না!
রাম অনেক সহ্য করতে পারিতেন, কিন্তু এতটা কী সহা যায়? নিজে দশরথ, এমনকি রাণীরা অবধি ছুটিয়া আসিতেছেন। তাঁহাদের কান্নায় বুঝি পাথরও গলিয়া যায়, মানুষ তো মানুষ। রাম অস্থির হইয়া সুমন্ত্রকে ক্রমাগত বলিতেছেন, জোরে চালাও! কিন্তু সুমন্ত্র জোরে চালাইবেন কি? এদিকে যে রাজা নিজে বলিতেছেন রথ থামাও! মা কৌশল্যা হা রাম! হা সীতা! হা লক্ষ্মণ। বলিয়া এলোচুলে পাগলিনীর মত ছুটয়া আসিতেছেন।
যাহা হউক, সুমন্ত্র যখন দেখিলেন যে রাম আর কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতেছেন না, তখন তিনি রথ খুব জোরেই চালাইয়া দিলেন। কাজেই তখন আর রথের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে না পারিয়া প্রায় সকলকেই ফিরিতে হইল।
দশরথকেও অনেক কষ্টে ফিরানো হইল। কিন্তু যতক্ষণ রথের ধুলা দেখা যাইতেছিল, ততক্ষণ তাঁহাকে ঘরে আনা গেল না। রথের দিকে চাহিয়া তিনি সেইখানে মাটিতে বসিয়া